পুরান ঢাকার ‘চিনির টুকরার মসজিদ’
পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় কে পি ঘোষ রোডের তিন মাথার মোড়ের ওপরেই মসজিদটির অবস্থান। অনেকে একে বলেন ‘চিনির টুকরার মসজিদ’।
‘ঢাকার অলংকার’ হিসেবে খ্যাতি ছিল এই মসজিদের। অসাধারণ কারুকাজ পুরো মসজিদে। ছাদে তিন গম্বুজ। সেই গম্বুজের চূড়া থেকে শুরু করে ভেতরে–বাইরের পুরো দেয়াল, মিনার সবকিছু চিনিটিকরির (চীনামাটির পাত্রের টুকরা) কাজ করা। এ কারণে অনেকে বলেন ‘চিনির টুকরার মসজিদ’।
সাধারণভাবে ‘কসাইটুলি জামে মসজিদ’ বা ‘কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ’ নামে প্রাচীন মসজিদটি পরিচিত।
পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় ২৬/২৭ কে পি ঘোষ রেডের তিন মাথার মেড়ের ওপরেই কসাইটুলি মসজিদের অবস্থান। কসাইটুলিতে এক সময় মাংস বিক্রেতাদের বসবাস ছিল। সেই সূত্রে এলাকার নামকরণ। নয়াবাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকের মহল্লাটিই কসাইটুলি। এর একটি অংশের নাম সামসাবাদ। মোগল আমল থেকে কসাইটুলিতে মহল্লার সরদারদের নেতৃত্বে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সরদারেরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কমরউদ্দিন সরদার ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান। ব্রিটিশ আমলে কসাইটুলি ঢাকার সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
এশিয়াটিক সোসাইটির ‘ঢাকা কোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, এখানে নিয়মিত নাট্যচর্চা হতো। ঢাকার আর্মেনীয়রা এই নাট্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। কসাইটুলি মসজিদটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এবং এটি ‘ঢাকার অলংকার’ হিসেবে খ্যাত।
মসজিদের পশ্চিম দিকের বাইরের দেয়ালের নিচে প্রতিষ্ঠার সময় লেখা হিজরি ১৩৩৮ (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। আবদুল বারী নামের এক ব্যবসায়ী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ধনাঢ্য ছিলেন তা বলা বাহুল্য। অনেক জমি দান করেছিলেন মসজিদের জন্য। মসজিদটি টিকে থাকলেও কালক্রমে সেই জমি নানা জনে নানা কায়দায় নিজেদের করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ মসজিদ পরিচালনা কমিটির।
এককথায় বললে কসাইটুলি মসজিদের অলংকরণ অসাধারণ। সরাসরি না দেখলেও টেলিভিশনে অনেকে মসজিদটি দেখে থাকবেন। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিটিভির আজানের সময় কসাইটুলি মসজিদ প্রায় সময় দেখানো হতো। মূল মসজিদ আকারে তেমন বড় নয়। চুন, সুরকি, ইটের দেয়ালের ওপর চিনিটিকরির কাজ। অনেক রঙের চীনামাটির টুকরা বসিয়ে ফুল–লতাপাতা, আঙুরের গুচ্ছসহ নান্দনিক নকশা তৈরি করা হয়েছে মসজিদের চারদিকের দেয়ালের ভেতরে–বাইরে সর্বত্র। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মোগল স্থাপত্যরীতি অনুসারে মাঝের গম্বুজটি বড়। এই গম্বুজগুলো চীনামাটির সাদা টুকরার সঙ্গে নীল আর সবুজ রঙের চাঁদ-তারা ও ফুলের পাপড়ির অলংকরণে সজ্জিত। চার কোণে রয়েছে অষ্টভুজ বুরুজ।
এ ছাড়াও পশ্চিমের দেয়ালের বাইরে পরস্পর যুক্ত দুটি করে চারটি সরু মিনার। এমন মিনার আছে উত্তর-দক্ষিণ পাশের দেয়ালেও। এই মিনার ও বুরুজগুলোর শীর্ষে আছে মানানসই আকারের গম্বুজ। পশ্চিম দিকের দেয়ালের বাইরের অংশ মিনার ও বুরুজগুলোর মধ্যবর্তী অংশে খিলান আকৃতির নকশা। এগুলোর মধ্যে নীল, সবুজ, বেগুনি, খয়েরি এমন নানা রঙের চীনামাটির টুকরা বসিয়ে ফুল, লতাপাতা, টবে লাগানো ফুলগাছ; নান্দনিক জ্যামিতিক নকশা আর পবিত্র কালেমা ও কোরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অলংকৃত। খিলানের কিনার, ভেতরের প্রধান মেহরাব, পশ্চিমের দেয়ালের দুটি কুলঙ্গির কিনার দিয়ে আছে চুন–সুরকির আস্তরের চমৎকার নকশা এবং তার ওপরে চিনিটিকরির অনেক সূক্ষ্ম কারুকাজ।
ঢাকায় চিনিটিকরির অলংকরণ করা আরেকটি বিখ্যাত মসজিদ আছে। সেটি আরমানিটোলার তারা মসজিদ। তারা মসজিদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গা ও সুপরিকল্পিত ভূমিবিন্যাসের জন্য এ মসজিদের সৌন্দর্য অন্যরকম। অনেক দূর থেকে মসজিদটি দেখা যায়।
কসাইটুলি মসজিদের ক্ষেত্রে তেমন নয়। এই মহল্লার গলিগুলো খুবই সংকীর্ণ। মসজিদের চারপাশে অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকানপাটে ঘিঞ্জি পরিবেশ। জায়গার অভাবে মসজিদের সম্প্রসারণও হয়েছে পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে খানিকটা খাপছাড়া ভাবে। আর এখন অর্থাভাবে মসজিদটির পরিচর্যা ও সংস্করণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাইরের দেয়াল থেকে চীনামাটির টুকরাগুলো ঝরে পড়ছে। জমে আছে ধুলার আস্তর।
গত শুক্রবার কসাইটুলি জামে মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, মসজিদের নামে অনেক জায়গা ছিল। সেগুলো অনেকে নিজেদের অধিকারে নিয়েছেন। অর্থে, রাজনৈতিক শক্তিতে তাঁরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। ফলে তাঁদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০০২ সাল থেকে মসজিদের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছিল। তখন আধা কাঠার মতো জায়গা কিনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন জায়গার পরিমাণ ছয় কাঠার মতো। মসজিদের কোনো আয়ের উৎস নেই। মুসল্লিদের দানের ওপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে তিনতলা পর্যন্ত নতুন করে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ইদানীং যে দান আসছে, তাতে উন্নয়নমূলক কাজ করা যাচ্ছে না।
খতিব মুফতি মাওলানা মো. ফরিদ উদ্দিনের কাছে জানা গেল, পুরোনো মসজিদের ভেতরে দুটি কাতার হয়। এখানে প্রায় ৩০ জন মুসল্লি নামাজে দাঁড়াতে পারেন। সম্প্রসারণের পর পুরোনো–নতুন অংশ মিলিয়ে তিন হাজারের মতো মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। একটি হেফজখানা ও মাদ্রাসা পরিচালিত হয় মসজিদে।
শতবর্ষের প্রাচীন কসাইটুলি মসজিদের চারপাশে ঘুরে আদি মসজিদটির মলিন ও ক্ষয়িষ্ণু চেহারা চোখে পড়ল। বিশেষ করে পশ্চিম দিকের বাইরের দেয়ালের অবস্থা বেশ খারাপ। মুসল্লির সংখ্যা বেড়েছে, নতুন করে সম্প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু আদি মসজিদটির পরিচর্যা তেমন হয়নি। সৌন্দর্য যতই থাক, যত্ন ও পরিচর্যা না থাকলে সেই রূপ যে ঝরে যায়—কসাইটুলি মসজিদ কি তারই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে?