তাঁদের একেকজনের গল্প একেক রকম, তবে ঠিকানা একই
প্রধান ফটক পার হয়ে কিছুটা হেঁটে ভেতরে গেলে পাশাপাশি দুটি ভবন। সুনসান নীরবতায় বোঝার উপায় নেই, এখানে কোনো বাসিন্দা আছেন। প্রতিটি ঘরের দরজা ভেড়ানো। তবে ভেতরে একজন করে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাঁদের কেউ শুয়ে আছেন, কেউ বই পড়ছেন। ফেলে আসা অতীতের কথা ভেবে স্মৃতিকাতরও হচ্ছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনটা এভাবেই কাটাচ্ছেন প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দারা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দারা নীরবে-নিভৃতেই ঈদের দিন কাটিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ। দুপুরের খাবারের পর নিজেদের কক্ষে একাকী সময় কাটাচ্ছিলেন প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দারা।
ঈদের দিন সকালে পরোটা, মুরগির মাংস ও সেমাই খেতে দেওয়া হয়েছে প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের। দুপুরে পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির মাংস, জর্দা ও কোমল পানীয়। আর রাতে ভাতের সঙ্গে রুই মাছ, মুড়িঘন্ট ও ডালের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রবীণ নিবাসে তুলনামূলক ‘নতুন বাসিন্দা’ নূরুল ইসলাম। অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তা তিন মাস ধরে আছেন এখানে। নূরুল ইসলামের এক ছেলে কানাডা থাকেন, আরেক ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজের মতো সময় কাটাতে প্রবীণ নিবাসে চলে এসেছেন। দুপুরের খাবার খেয়ে বই পড়ছিলেন।
নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ছেলে কানাডা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। এই প্রবীণ নিবাসে স্বাধীনতা আছে। নিজের মতো থাকা যায়। তবে পরিবার ছাড়া ঈদের বিষয়টা নতুন। পরিবারের সঙ্গে ঈদের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। ঈদের দিনে ভালো খাবার দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’
আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে ১৩ বছর ধরে আছেন আরেক ব্যক্তি। নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না তিনি। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল বহু আগে। তাঁর একমাত্র মেয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। বললেন, ‘এখন আর খারাপ লাগে না। আশপাশের কক্ষে যারা থাকে, তাদের সঙ্গে কথা বলি।’
জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী, ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে প্রবীণ ভবনে ৫০ শয্যার প্রবীণ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) এবং পাশে একটি ভবনে ৫০ শয্যার প্রবীণ নিবাস রয়েছে। নিবাসে বাসিন্দা আছেন ৩৬ জন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, যাঁদের বয়স ৬০ বছর এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, শুধু তাঁরাই এই প্রবীণ নিবাসে থাকতে পারবেন।
আগারগাঁওয়ের এই প্রবীণ নিবাসে ১৩ বছর ধরে আছেন আরেক ব্যক্তি। নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না তিনি। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল বহু আগে। তাঁর একমাত্র মেয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। ওই ব্যক্তির কাছে একাকী ঈদ কাটানো নতুন কিছু নয়। অন্যান্য দিনের মতোই নিজের কক্ষে বসে মোবাইলে গান শুনছিলেন। বললেন, ‘এখন আর খারাপ লাগে না। আশপাশের কক্ষে যারা থাকে, তাদের সঙ্গে কথা বলি।’
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তা অনেক দিন এই প্রবীণ নিবাসে ছিলেন। গত মাসে এই নিবাস ছেড়ে মিরপুরে ছেলের বাসায় উঠেছেন। তিনি ঈদের দিন দুপুরে দেখা করতে এসেছিলেন পুরোনো সঙ্গীদের সঙ্গে। নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া ওই ব্যক্তি বললেন, ‘এই প্রবীণ নিবাস অনেকটা হোস্টেলের মতো। রুমভাড়া, খাওয়া খরচের একটা অংশ বাসিন্দাদের দিতে হয়। এখানে থেকে আমার মনে হয়েছে, প্রবীণ লোকদের কথা শোনার মতো মানুষের অভাব। এখানে অনেক একা লাগে।’
আশপাশের কক্ষের লোকজনের সঙ্গে গল্প করে, বই-পত্রিকা পড়ে সময় কাটে। ঈদের দিন স্বজনেরা এসেছিলেন। অনেক আত্মীয় খাবারদাবার রান্না করে পাঠান।আউয়াল চৌধুরী, প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা
এই নিবাসের বাসিন্দাদের অনেকের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল। কারও পরিবারে দেখভাল করার লোক না থাকায় এখানে থাকছেন। আবার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েনেও কেউ কেউ এখানে এসে থাকছেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আউয়াল চৌধুরীর বিষয়টিও তেমন। নিজের ছেলের বাড়িতে থাকতেন। মনোমালিন্য হওয়ায় এখানে চলে এসেছেন। আজ ঈদের দিনও ছেলে, নাতি-নাতনিরা তাঁকে দেখতে এসেছিল।
দুপুরে নিজের কক্ষের বিছানায় শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছিলেন আউয়াল চৌধুরী। তিনি বলেন, আশপাশের কক্ষের লোকজনের সঙ্গে গল্প করে, বই-পত্রিকা পড়ে সময় কাটে। ঈদের দিন স্বজনেরা এসেছিলেন। অনেক আত্মীয় খাবারদাবার রান্না করে পাঠান।
তবে ঈদের দিনেও প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মনে আনন্দ নেই। প্রতিষ্ঠানটির ১১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এক বছর ধরে বেতনের একটা বড় অংশ পাচ্ছেন না। অনিয়মের অভিযোগ থাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের থোক বরাদ্দ ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ছাড় করা হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ কমিয়ে ৪ কোটি টাকা করা হলেও তা-ও ছাড় করা হয়নি।
বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক মো. মোকতার হোসেন বাইগামের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মোকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দারা ঈদের দিন বেশি অসহায় অনুভব করেন। মানসিকভাবে দুর্বল থাকেন। ঈদের দিন কারও কারও স্বজন আসেন, দেখে চলে যান। এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবারই পেছনে পারিবারিক সংকটের গল্প আছে।