খাল ভরাট করে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, রিকশা গ্যারেজ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রামচন্দ্রপুর খাল ভরাট করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যালয় বানিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খালের ওই অংশে দলীয় কার্যালয় ছাড়াও রিকশার গ্যারেজ, রিকশাচালকদের থাকার ঘর, টং দোকান, রান্নাঘরসহ বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
গত শুক্রবার মোহাম্মদপুরের ভাঙা মসজিদ এলাকায় গিয়ে খাল ভরাট করে অবৈধ দখলের এমন চিত্র দেখা গেছে। রিকশা গ্যারেজের মালিক, টং দোকানি ও বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অনুমতি নিয়ে ওই জায়গায় থাকছেন। এর জন্য প্রতি মাসে কাউন্সিলরকে ৩ থেকে ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া স্থাপনা নির্মাণে তাঁদের সবাইকে এককালীন কিছু টাকা দিতে হয়েছে।
রামচন্দ্রপুর খালের ওই অংশ ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ খাল দখলকারীদের অনুমতি দেওয়া ও টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ নিজের অস্তিত্ব টিকানোর জন্য যে চেয়ারে থাকে, তাকেই বিক্রি করে দেয়।
রিকশা গ্যারেজ, টং দোকান, বস্তিঘর
খালের ভরাট হওয়া জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ রয়েছে আমিনুল ইসলামের। গ্যারেজে ৪০টি রিকশা রাখা হয়। চার মাস ধরে ওই জায়গায় রিকশা রাখছেন বলে জানান গ্যারেজমালিক আমিনুল। তিনি বলেন, রিকশার গ্যারেজটি করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অনুমতি নিয়েছেন। গ্যারেজ বাবদ তিনি প্রতি মাসে কাউন্সিলর কার্যালয়ে ৭ হাজার টাকা দেন। কার হাতে টাকা দেন, জানতে চাইলে বিষয়টি তাঁর ভাই অলি দেখেন বলে জানান তিনি।
প্যাডেলচালিত রিকশার একটি গ্যারেজ আছে মোহাম্মদ পারভেজের। ওই গ্যারেজে ভ্যানও রাখা হয়। সব মিলিয়ে মোট ২৩টি রিকশা ও ভ্যান রাখা হয় সেখানে। পারভেজ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দেন বলে দাবি করেছেন।
পারভেজের গ্যারেজের উল্টো দিকেই খোকন শিকদারের ক্যারম খেলার জায়গা। টিনের অস্থায়ী ছাউনির নিচে ক্যারম খেলার চারটি বোর্ড বসানো। সন্ধ্যার পর রিকশাচালকেরা ক্যারম খেলেন বলে জানান খোকন। এর জন্যও টাকা দেওয়া লাগে। তবে কাকে এবং কত দেন, তা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
সেলিম আকন্দ নামের আরেক মালিকের ৩৪টি রিকশার গ্যারেজ আছে খালের মধ্যে। তিনি বলেন, প্রতি মাসে কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে ৭ হাজার করে টাকা দিয়ে আসেন।
এ ছাড়া আমিনুলের গ্যারেজের পাশে ত্রিপল দিয়ে ঘরের মতো বানানো স্থাপনায় সাদিক এগ্রো ফার্মের রান্নাবান্না হয় বলে জানালেন স্থানীয় লোকজন। এ বিষয়ে সাদিক এগ্রো ফার্মের মালিক ইমরান হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসে তাঁরা নিম্ন আয়ের লোকজনকে ইফতারি খাওয়ান। তাঁদের রান্নার জন্যই সেখানে অস্থায়ী একটি ছাউনি করা হয়েছিল।
টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরটি সাতমসজিদ হাউজিং ইউনিট আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়। এটি ব্যবহার করেন ওই ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনসহ অন্য নেতারা। বক্তব৵ নিতে আলমগীর হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
খালের এ দশা যেভাবে
২০০৮-০৯ সালের দিকে ভাঙা মসজিদসংলগ্ন খালের ওই অংশে মাটি ভরাট করে একটি ট্রাক টার্মিনাল করা হয়েছিল। ওই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ওই আসনের সংসদ সদস্য। মূলত তখন থেকেই সেখানে অবৈধ দখলের শুরু।
তবে খালটি আরও আগে মরতে শুরু করেছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা উত্তর সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, ১৯৮৮ সালের বন্যার পরে বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে মূল রামচন্দ্রপুর খালের সঙ্গে এ অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে উজান থেকে ভাটির দিকে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। খালে দখলদারদের দৌরাত্ম্য তখন থেকেই শুরু হয়।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ওই অংশে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরও দখলের বিষয়টি জানেন। কিন্তু অভিযানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
খাল উদ্ধার হচ্ছে না কেন
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালের দায়িত্ব বুঝে নেয় ঢাকা উত্তর সিটি। এরপর খাল উদ্ধারে অভিযান, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, খাল খনন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে মেয়র আতিকুল ইসলাম ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অন্তত ছয়বার রামচন্দ্রপুর ও লাউতলা খাল এলাকায় গেছেন।
ওই ছয়বারের মধ্যে পাঁচবারই মেয়র গেছেন বছিলা হাউজিং এলাকায়। আর একবার, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়র যান চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এ সময়ের মধ্যে মেয়র ও কর্মকর্তারা একবারও ভাঙা মসজিদসংলগ্ন সাতমসজিদ হাউজিং এলাকায় রামচন্দ্রপুর খালের ওই অংশে যাননি। সেখানে কোনো উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ বলেন, সেখানে অনেকবার উচ্ছেদ অভিযানের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কেন সিটি করপোরেশন থেকে উচ্ছেদ অভিযান হয়নি, সেই কারণটা অজানা।
সাতমসজিদ হাউজিং অংশের খাল উদ্ধার না করার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে বা কারা দখলদার, সেটা বুঝি না। শুধু বুঝি খাল উদ্ধার করতে হবে। তাই খালের সব অংশেই অভিযান চালানো হবে, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। খাল খননে ঠিকাদারের মাধ্যমে ভাড়ায় আনা খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) ব্যবহারের সময়সীমা শেষ হওয়ায় ওই অংশে যেতে সময় লাগছে।’
নদী ও জলাভূমি গবেষক রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ প্রথম আলোকে বলেন, খালটির ওই অংশ একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানে রীতিমতো খাল ভরাট করে দখল করতে দেখা গেছে। কিন্তু খাল উদ্ধারে কোনো ধরনের ইচ্ছা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে দেখা যায়নি। বিভিন্ন সময় একেকটি আইন করে সব দখলকে জায়েজ করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।