লেবু টক, সে তো সবারই জানা। তবে মিষ্টি স্বাদের লেবুও পাওয়া যাচ্ছে বৃক্ষমেলায়। সঙ্গে আছে গোলাপি রঙের কোষের কাঁঠালসহ হরেক রকমের দেশি–বিদেশি ফল, ফুল, ঔষধি, বনজ গাছপালার বিপুল বৈচিত্র্যময় সমাবেশ।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে ৫ জুন থেকে বন বিভাগের আয়োজনে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা। চলবে আগামী ১৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিবছর বর্ষায় বন বিভাগ জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ অভিযানের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে বৃক্ষমেলার আয়োজন করে থাকে। ঢাকায় জাতীয় মেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সারা দেশের মেলার। পরে পর্যায়ক্রমে সারা দেশের বিভাগ, জেলা, এমনকি অনেক উপজেলা পর্যায়েও বৃক্ষমেলা হয়ে থাকে।
রোববার মেলা ঘুরে দেখা গেল, স্টলগুলোর ভেতরে এবং সামনের খোলা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ছোট চারা থেকে ফল–ফুলে ভরা হরেক রকমের গাছ। এখন ফলেরই মৌসুম। বিশেষ করে আম ধরা গাছগুলো আমবাগানের আবহ সৃষ্টি করেছে। বড় টবে লাগানো কাঁঠাল, জাম, লটকন, লেবু, জামরুল, করমচার মতো দেশি জাতের ফল ধরা গাছ রয়েছে মেলায়। পাশাপাশি রয়েছে বিদেশি পার্সিমন, লঙ্কান, রাম্বুটান, পিচসহ নানা জাতের বড় গাছ ও চারা।
চাঁদনী নার্সারিতে দেখা গেল, মিষ্টি লেবু আর গোলাপি কাঁঠাল। ল্যাবএইড অ্যাগ্রোর স্টল ভরা শুধুই হরেক জাতের অর্কিডে। হোসেন নার্সারি থেকে চারা কিনছিলেন রোজলিনা হক। গাজীপুরের শ্রীপুরে তাঁর বাগানবাড়ি। সেখানে ফলের গাছ রোপণ করবেন। ফল ধরা বড় গাছ তাঁর পছন্দ। বেশ বড় আকারের একটি পার্সিমনগাছ কিনেছেন ১০ হাজার টাকায়, একটি জাপাটিকাবা কিনেছেন ৫ হাজার টাকায়। দুটি গাছেই ফল এসেছে। তিনি জানালেন ১৫ বছর ধরে বাগানবাড়ি গাছে গাছে ভরিয়ে তুলেছেন। প্রতিবছর এই মেলা থেকেই গাছ কেনেন। এবারও এসেছেন গাছ কিনতে।
মেলায় ফুলের মধ্যে গোলাপ, বেলি, টগর, জুঁইসহ আছে জারবেরা, মুসান্ডা, হাসনাহেনা প্রভৃতি। স্টলের সামনের লম্বা হুকের সঙ্গে ঝুলছে ফুলে ফুলে ভরা ডেনড্রবিয়াম, মোকারা, ভেন্ডা, ক্যাটেলিয়া, ফেলোনপসিসের মতো অর্কিড। স্টলের ভেতরে রাখা জিমনো ক্যালিসিয়াম, মামিলারিয়া, গোল্ডেন ব্যারেল, অ্যারিস্টোফাইটামসহ বিচিত্র জাতের ক্যাকটাস আর সাকুলেন্টসহ সৌন্দর্যময় উদ্ভিদকুল।
বাগানি মো. গোলাম ফিরোজের সঙ্গে দেখা হলো জান্নাত নার্সারির সামনে। তিনি কিনেছেন হরেক রকম ফুল আর ক্যাকটাস। সেন্ট্রাল রোডে তাঁর বাড়ির ছাদে বছর দশেক ধরে বাগান করছেন বেসরকারি ব্যাংকের এই কর্মকর্তা। তিনি জানালেন, প্রায় সব রকম ফলের গাছই আছে তাঁর ছাদবাগানে। এখন কিছু ফুল আর শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা কিনতে মেলায় এসেছেন। বৃক্ষমেলার একটি বৈশিষ্ট্য তাঁর বেশ ভালো লাগে; তা হলো—গাছের দামে খুব বেশি তারতম্য হয় না। প্রতিবছর মেলায় প্রায় একই রকম দাম থাকে।
বাজারে অন্য সব পণ্যের দাম বাড়লেও গাছের চারার দামের বিশেষ হেরফের না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জান্নাত নার্সারির কর্মকর্তা খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানালেন, কিছু কিছু গাছ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সেগুলোর দাম হয়তো বাড়ে। তবে অধিকাংশ গাছের চারা নার্সারিগুলো নিজেরাই উৎপন্ন করে, তাই দাম মোটামুটিভাবে স্থিতিশীল থাকে। এবার মেলা শুরুর কিছুদিন পরই কোরবানির ঈদ পড়ায় বিক্রি কিছুটা কমেছে। তবে শহরে লোকজন ফিরে এলে বিক্রি বাড়বে বলে তাঁরা আশা করছেন।
একই রকম মন্তব্য করলেন ব্র্যাক নার্সারির কর্মকর্তা সুব্রত কুমার ঘোষ। মেলায় চারার দাম বাড়েনি। শুরু থেকেই বিক্রি বেশ ভালো। ব্র্যাকে প্রচুর দেশি ফল ও ফুলের ছোট চারা রয়েছে, যেগুলো সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে পাওয়া যাবে। তিনি জানালেন, ঢাকায় সাধারণত ছাদে রোপণ করার উপযোগী জাতের ফল ও ফুল গাছই বেশি বিক্রি হয়।
বৃক্ষমেলার তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী পরিদর্শক নিগার সুলতানা জানালেন, এবার জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযানে বন বিভাগ সারা দেশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৩০ লাখ ফলদ, বনজ ও ঔষধি উদ্ভিদের চারা রোপণ করবে। ঢাকায় চলতি জাতীয় বৃক্ষমেলায় এবার ৭৫টি বেসরকারি নার্সারি অংশ নিয়েছে। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১১৮ ইউনিটের স্টল রয়েছে মেলায়। বিক্রিও হচ্ছে ভালো। তিনি জানালেন, সর্বশেষ ২১ জুন বিক্রি হয়েছে ৬৫ লাখ ৯৮০ টাকা। চারার সংখ্যা ৯৫ হাজার ৮৪১টি। সবচেয়ে বেশি দাম ৪০ হাজার টাকায় একটি ফল ধরা রাম্বুটানগাছ বিক্রি হয়েছে ফয়সল নার্সারি থেকে।
মেলা ঘুরে দেখা গেল, গাছের চারা ছাড়াও গাছ রোপণের জন্য জিও ব্যাগ, কোকো পিট, সার, মাটির সুদৃশ্য নকশা করা টব, কৃষিযন্ত্রের বিপুল সমারোহ অনেক স্টলে। এই বর্ষায় বৃক্ষপ্রেমীরা তাঁদের পছন্দের গাছ ও চারা সংগ্রহের জন্য আসছেন বৃক্ষমেলায়। আবার কেবল বেড়ানোর জন্য এই মেলায় এলেও ফুল-ফল–সবুজের নিবিড় সমাবেশে প্রফুল্ল হবে চিত্ত।