বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তরুণদেরও যুক্ত হওয়া উচিত
বছর দেড়েক আগে মাধ্যমিক পাসের পর বিয়ে হয় কিশোরী মেয়েটির। মেয়েটির ভাষ্যমতে, তার পরিবারে তখন আর্থিক সংকট চলছিল। তাই বিয়ের প্রস্তাব এলে মা-বাবা বাধা দেননি। কথা ছিল, বিয়ের পরও তিনি পড়াশোনা করতে পারবেন। কিন্তু বিয়ের পর দেখা গেল উল্টো চিত্র। সংসারের কাজেই তার দিন চলে যেত। এর মধ্যে সন্তান নেওয়ার জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাপ দিতে থাকেন। একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়ে গর্ভধারণ করলেও গর্ভপাত হয়ে যায়। পড়াশোনাও আর এগোয়নি।
বুধবার রাজধানীতে বাল্যবিবাহ নিরসন নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী এসব কথা বলছিল। অনুষ্ঠান শেষে এই প্রতিবেদককে তিনি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বিয়েটা এখনো টিকে আছে। এসব কথা বলেছি জানলে সমস্যা হতে পারে।’
রাজধানী ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত ডেইলি স্টার সেন্টারে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। ‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ: পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণদের ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামের এই সভায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে তরুণদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে বহু পুরোনো এই সামাজিক সংকট মোকাবিলায় নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।
সভায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও তরুণেরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করতে তাঁদের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন এমন কয়েকজন কিশোরী-তরুণী তাঁদের চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন। কয়েকজন জানান, অনেক সময় বাল্যবিবাহ দেওয়া পরিবারগুলো কারণ হিসেবে নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক প্রথা, আর্থিক সংকট, ছেলেমেয়েদের প্রেমঘটিত সম্পর্ককে দায়ী করে। প্রশাসনের নজরদারির দুর্বলতাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
সভায় জানানো হয়, দেশে এখনো বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন থাকলেও জনসচেতনতার অভাব, মেয়েদের জন্য যথার্থ বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় আইনটি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
সভায় বাল্যবিবাহ রোধে তরুণদের ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনে তরুণেরা ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের মতো সামাজিক পটপরিবর্তনে তরুণদের সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। মেয়েদের নিজেদেরও আইন ও অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে, সচেতন হতে হবে। কারণ, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হলে প্রতিকার চাওয়া যায় না।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণদের ভূমিকা ও করণীয় নিয়ে সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক (প্রফেসরিয়াল ফেলো) এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর পটপরিবর্তন হয়েছে। এখন নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। তরুণেরা কীভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ জানান, গ্লোবাল ইনোভেশন ফান্ডের সহায়তায় ব্লাস্ট স্থানীয় যুবগোষ্ঠী নিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্যে ‘সেফ প্লাস’ নামের কর্মসূচি নিয়েছে। এই কর্মসূচি ৫০টি শহর এলাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২৫ জন প্যারালিগ্যাল তাঁদের কমিউনিটির লোকজনকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানিয়েছেন। তাঁরা ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী ১০-১৫ জন যুবদের ৫০টি দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। দলটি এখন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে।
সভাটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, এখন বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তরুণদের ভূমিকাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন প্রতিনিধি ফারহানা হোসেন বলেন, ‘আমি নিজে বাল্যবিবাহসহ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। এ কারণে আমাকে অনেক সময় হেনস্তার শিকারও হতে হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেক পরিবার মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেয়। পরিবারগুলোতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। মেয়ে হয়ে জন্মানো কোনো দুর্বলতা না, সেটা বুঝতে পারা উচিত।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম, স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ফারজানা ব্রাউনিয়া, সাজেদা ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা উপদেষ্টা সাজেদা আমিন (অনলাইনে যুক্ত হন), বাংলাদেশ উইমেন্স হেলথ কানেকশনের (বিডব্লিউএইচসি) নির্বাহী পরিচালক শরীফ মোস্তফা হেলাল, ব্র্যাকের মিতালি জাহান, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী মোবাশ্বেরা করিম, সেফ প্লাস কর্মসূচির কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য শারমিন আক্তার, প্যারালিগ্যাল হালিমা খাতুন, ফারজানা আক্তারসহ অনেকে। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ব্লাস্টের সহকারী পরিচালক তাপসী রাবেয়া।