কামরাঙ্গীরচরে দক্ষিণ সিটির প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বাসিন্দারা
সেবামূলক কাজ করা সিটি করপোরেশনের কাজ। তা না করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বসবাসরত প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করে সেখানে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল করতে চায়। শত বছর ধরে বসবাসরত ওই সব বাসিন্দাকে বাস্তুচ্যুত করে এমন প্রকল্প নেওয়া কতটা যৌক্তিক।
আজ শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ড্যাপ-কামরাঙ্গীরচর, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন এবং জনগণের ভাবনা’শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দারা এ প্রশ্ন তোলেন। কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের ব্যানারে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা বলেন, গত বছরের ১১ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, কামরাঙ্গীরচরে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হবে। ওই দিন তাঁরা জানতে পেরেছেন পুরো এলাকার ২০ লাখ বাসিন্দাকে বাস্তুচ্যুত করে সেখানে এই প্রকল্প নেওয়া হবে। সেখানে ১ হাজার ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে ৫০তলা ভবন নির্মাণ করা হবে বলেও তাঁরা মেয়রের বক্তব্যে জানতে পেরেছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের না জানিয়ে এমন প্রকল্প নেওয়ায় তাঁরা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
কামরাঙ্গীরচরে কী ধরনের প্রকল্প হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে বৈঠকে ওই এলাকার বাসিন্দারা বলেন, কখন, কীভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে, তাঁরা এখন পর্যন্ত জানতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে, কামরাঙ্গীরচরে যাতে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া না হয়। সিটি করপোরেশনের চিঠি পেয়ে রাজউক এখন আর কামরাঙ্গীরচরে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে না।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত কামরাঙ্গীরচর এলাকা। এই এলাকায় ২০ হাজারের বেশি ভবন রয়েছে। মিশ্র ভূমি ব্যবহারের এই এলাকায় শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজ থেকে নিজামবাগ বেড়িবাঁধ পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কামরুল সরণির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া এলাকা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে পাঁচ তারকা হোটেল বানানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ওই এলাকায় পরিকল্পিত আবাসন, কনভেনশন হল, ৫০ তলাবিশিষ্ট নান্দনিক ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীর হয়ে চার সারির সড়ক নির্মাণ করা হবে। এভাবেই কামরাঙ্গীরচরকে একটি আধুনিক নগরীতে পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির এমন পরিকল্পনার প্রতিবাদেরই আজ এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করে আসছেন। দক্ষিণ সিটির এই প্রকল্পকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়, তাঁরা কোথায় যাবেন?
শাহ আলম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘মেয়র তাঁদের বলেছেন, “তোমরা টাকা পাবা অন্য জায়গায় গিয়ে থাকবা।” এটা অবাস্তব পরিকল্পনা। এটা বাতিল করতে হবে।’
সবির উদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের জানানো ছাড়া কেন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।’ অপ্রয়োজনীয় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সরে আসতে আহ্বান জানান তিনি।
কামরাঙ্গীরচরের প্রতিটি অলিগলিতে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এমন দাবি করে ওই এলাকার বাসিন্দা মো. দুলাল বলেন, ‘উন্নয়নকাজের ব্যত্যয় হোক, তা আমরা চাই না। আমাদের ওই এলাকায় রেখেই যাতে উন্নয়ন করা হয়, এটাই আমরা চাই।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কবি নির্মলেন্দু গুণের। অসুস্থতার কারণে তিনি অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তবে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সরে আসার আহ্বান জানাই।’ এর আগে আড়িয়ল বিল রক্ষার জন্য মানুষ মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিলেন। পরে ওই প্রকল্প বাতিল হয়েছে। আড়িয়ল বিলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এমন প্রকল্পের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না নির্মলেন্দু গুণ। তিনি বলেন, এই প্রকল্প মানুষের মধ্যে আশার চেয়ে ভীতির সঞ্চার করছে বেশি। স্থানীয় লোকজনের মতামত নিয়ে কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, তেমন প্রকল্প নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের উপকার লাভ না দেখে প্রকল্প নেওয়া হলে কামরাঙ্গীরচরের মানুষ রুখে দাঁড়াবে। তিনিও সেই আন্দোলনে যুক্ত থাকবেন।
গোলটেবিল বৈঠকে ফারুক হোসেন নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা যেমন সোজা ভাষায় কথা বলতে পারি, আবার বাঁকাও হতে পারি।’ প্রকল্পটি অন্য এলাকায় বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানান তিনি।
আয়োজক সংগঠনের সদস্যসচিব এস এম মাওলা রেজা বৈঠকের সঞ্চালনা করেন। আর মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের সমন্বয়ক হাসান আহমেদ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় স্থপতি ইকবাল হাবিব, নগর–পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের নাম ছিল। তবে তাঁদের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি।