বিমানবন্দর ও বনানী পদচারী–সেতুতে চলে না চলন্ত সিঁড়ি

বিমানবন্দর পদচারী–সেতুর চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ। সিঁড়ির মাথায় ঘুমাচ্ছেন ভবঘুরেরা।ফাইল ছবি প্রথম আলো

পদচারী–সেতুর চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) বন্ধ। রাস্তা পারাপারে ওই বন্ধ সিঁড়ি দিয়েই দুই হাতে ভারী দুটি ব্যাগ নিয়ে হেঁটে ওপরে ওঠেন আরাফাত হোসেন। উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলেন। তাই ওঠা শেষে খানিক সময় জিরিয়ে নিলেন।

পরে অনেকটা ক্ষোভ জানিয়ে আরাফাত হোসেন বলেন, ‘এই সিঁড়ি থাকতেও যদি হাঁইটাই ওঠা লাগে, তাইলে এইডা এহানে রাইখা মাইনষের লাভটা কী? এক বছর ধরে সিঁড়িগুলা নষ্ট হইয়া পইড়া আছে। কেউ ঠিকও করে না, সরাইয়াও নেয় না।’

চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ব্যস্ত রাস্তা পারাপারে আরাফাত হোসেনের দুর্ভোগ পোহানোর এ চিত্র রাজধানীর বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন পদচারী–সেতুর। তাঁর মতোই নিত্যদিন দুর্ভোগ সয়ে এই পদচারী–সেতু ব্যবহার করেন আরও অনেকে। এদিকে রাজধানীর বনানী পদচারী–সেতুর চলন্ত সিঁড়ির অবস্থাও একই রকমের।  

চলন্ত সিঁড়িযুক্ত বিমানবন্দর পদচারী–সেতু ২০১৬ সালের আগস্টে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেতুটি নির্মাণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করে। চালুর পর বিভিন্ন সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চলন্ত সিঁড়িগুলো বন্ধ থাকে। উদ্বোধনের পরের বছরই টানা দুই মাসের জন্য অচল ছিল এসব চলন্ত সিঁড়ি।

বিমানবন্দর পদচারী–সেতুতে গত শনিবার দুপুরে কথা হয় আরাফাত হোসেনের সঙ্গে। গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকার বাসিন্দা তিনি। রাজধানীর উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁর কাপড়ের ব্যবসা রয়েছে। প্রতিদিন জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে করে তিনি বিমানবন্দর রেলস্টেশনে আসেন। সেখান থেকে পদচারী–সেতু দিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাসে উঠে যান আজমপুরে।

এই সিঁড়ি থাকতেও যদি হাঁইটাই ওঠা লাগে, তাইলে এইডা এহানে রাইখা মাইনষের লাভটা কী? এক বছর ধরে সিঁড়িগুলা নষ্ট হইয়া পইড়া আছে। কেউ ঠিকও করে না, সরাইয়াও নেয় না।
আরাফাত হোসেন, ব্যবসায়ী

আরাফাত হোসেনসহ বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ডে থাকা দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ওই পদচারী–সেতুর দুই পাশের চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ। ঠিক কবে থেকে এগুলো নষ্ট, তা জানা না থাকলেও সময়টি প্রায় এক বছর হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

সরেজমিন দেখা যায়, বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন ব্যস্ত সড়ক পারাপারে পদচারী–সেতুটি ব্যবহার করছেন শত শত মানুষ। এক পাশে বিমানবন্দর রেলস্টেশন ও অন্য পাশে বিমানবন্দর হওয়ায় সেতু ব্যবহারকারী অনেকের সঙ্গেই আছে ভারী ব্যাগ। কিন্তু চলন্ত সিঁড়ি না চলায় রাস্তা পারাপারে ভোগান্তিতে পড়ছেন তাঁরা। চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ দেখে অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন।

বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ির চলন্ত সিঁড়িটি অচল পড়ে আছে। বন্ধ সিঁড়ির প্রবেশপথের ফটকও।

পদচারী–সেতুটির নিচে পান-সিগারেট বিক্রি করেন সামছু মিয়া। তিনি বললেন, অনেকের সঙ্গে অনেক গাট্টিবোঁচকা, মালসামানা থাকে। সিঁড়ি নষ্ট থাকায় তাঁদের কষ্ট করে হেঁটে ওপরে উঠতে হয়। অনেকে নষ্ট সিঁড়ি নিয়ে গালমন্দও করেন।

চলন্ত সিঁড়িযুক্ত পদচারী–সেতুটি ২০১৬ সালের আগস্টে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেতুটি নির্মাণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করে। চালুর পর বিভিন্ন সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চলন্ত সিঁড়িগুলো বন্ধ থাকে। উদ্বোধনের পরের বছরই টানা দুই মাসের জন্য অচল ছিল এসব চলন্ত সিঁড়ি।

বনানী পদচারী–সেতুর দক্ষিণের দুই অংশেই চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ। প্রবেশপথের শুরুতে দুটি স্টিলের দরজা। সেগুলোতেও তালা ঝুলছে। সেতুর উত্তর দিকের নিয়মিত সিঁড়িই (হেঁটে ওঠার সিঁড়ি) ব্যবহার করছেন পথচারীরা।

চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ বনানী পদচারী–সেতুরও

বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার পদচারী–সেতুর চলন্ত সিঁড়িগুলোও প্রায় এক মাস ধরে বন্ধ। শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, এটির দক্ষিণের দুই অংশেই চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ। প্রবেশপথের শুরুতে দুটি স্টিলের দরজা। সেগুলোতেও তালা ঝুলছে। সেতুর উত্তর দিকের নিয়মিত সিঁড়িই (হেঁটে ওঠার সিঁড়ি) ব্যবহার করছেন পথচারীরা। তবে অনেকে যানবাহন চলাচলের ফাঁকে সুযোগ খুঁজে মূল সড়ক দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।

আবু সায়েম বনানীর ১১ নম্বর সড়কে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই এস্কেলেটরগুলো বন্ধ। কেন বন্ধ, কবে চালু হবে, এ–সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি কর্তৃপক্ষ দেয়নি। বিজ্ঞপ্তি দিলে ব্যবহারকারীদের জন্য ভালো হতো।

আবু সায়েম আরও বলেন, ‘মে মাসের আগেও প্রায় সময়ই চলন্ত সিঁড়িগুলো বন্ধ ছিল। কোনো দিন দেখি সিঁড়ি সচল। কোনো দিন আবার বন্ধ। কর্তৃপক্ষ কি চালায় না, নাকি নষ্ট হওয়ায় বন্ধ থাকে, কিছুই বুঝি না।’

আরও পড়ুন

চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার চলন্ত সিঁড়িযুক্ত এ সেতু চালু হয়েছিল ২০১৪ সালের শুরুতে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মল বায়ু, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের (কেইস) আওতায় সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল সোয়া তিন কোটি টাকার বেশি টাকা। এর মধ্যে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনেই ব্যয় হয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

বিমানবন্দরের পদচারী–সেতুর বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেতুর চলন্ত সিঁড়ির নষ্ট যন্ত্রাংশ মেরামতে চারবার দরপত্র আহ্বান করেও আগ্রহী ঠিকাদার পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ মে মাসে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্রাংশগুলো সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রাংশ এলেই পুনরায় এটি চালু করা হবে।

আর বনানী পদচারী–সেতুর বিষয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, ঈদের (পবিত্র ঈদুল আজহা) কয়েক দিন আগে সেতুর পূর্ব পাশের চলন্ত সিঁড়ির ছয়টি স্টেপ (ধাপ) নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো স্থানীয় বাজার থেকে দ্রুত কিনে লাগিয়ে সিঁড়ি চালু করা হবে। তবে পশ্চিম পাশের চলন্ত সিঁড়ি চালু আছে বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু সরেজমিন সিঁড়িগুলো বন্ধ দেখা যায়।

মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই এস্কেলেটরগুলো (বনানী পদচারী–সেতুর) বন্ধ। কেন বন্ধ, কবে চালু হবে, এ–সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি কর্তৃপক্ষ দেয়নি। বিজ্ঞপ্তি দিলে ব্যবহারকারীদের জন্য ভালো হতো।
আবু সায়েম, চাকরিজীবী

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব

চলন্ত সিঁড়িগুলো নষ্ট হওয়ার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির দুজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দুজন জানান, চলন্ত সিঁড়ি বিদ্যুতে চলে। এগুলোয় যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা দীর্ঘদিন অচল পড়ে থাকার কারণ, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা।

সঠিক পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টি উল্লেখ করে দুই প্রকৌশলী আরও জানান, সিঁড়িগুলো অনেকটা খোলামেলা অবস্থায় স্থাপন করা হয়েছে। রোদবৃষ্টি, ধুলাবালু, কাদা-পানি, সবকিছুই চলন্ত সিঁড়িগুলোয় সরাসরি পড়ে। এ কারণে সিঁড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের যে মেয়াদ (লাইফটাইম), সেটি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

দুই প্রকৌশলীর একজন জানান, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেও সিঁড়িগুলো দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অনেকের বাসাবাড়িতে লিফট থাকে। যেটিতে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো যান্ত্রিক ত্রুটি হয়। কিন্তু সেগুলো দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করা হয়। একইভাবে ছোটখাটো যান্ত্রিক ত্রুটি হয় চলন্ত সিঁড়িতেও। কিন্তু এগুলো দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এ কারণে তা দীর্ঘদিন অচল থাকে আর ভোগান্তি পোহান ব্যবহারকারীরা।

আরও পড়ুন