দেশে গত দেড় দশকে উন্নয়ন হয়েছে। জনগণের টাকায় প্রবৃদ্ধিও হয়েছে। কিন্তু সব পর্যায়ে দুর্নীতি, সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। সরকার ঘনিষ্ঠরা টাকার মালিক হচ্ছেন। পাশাপাশি সুশাসন ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। বেড়েছে ধর্মবিদ্বেষ। সামাজিক শক্তি বিলীন হয়ে গেছে। উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নাগরিক সমাজ দায় এড়াতে পারে না।
আজ শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মহান স্বাধীনতার ৫৩ বছর: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা চক্রে অংশ নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকেরা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সুশাসনের অভাব থাকলে জবাবদিহি থাকে না। সংসদে এখন ১০-১২ জনের বিরোধী দল রয়েছে। সেখানে কোনো জবাবদিহি নেই। জবাবদিহি না থাকলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবেই। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সরকারের বিচ্যুতি ধরিয়ে দিতে চায়। তিনি বলেন, সরকার এখন ব্যবসায়ীদের সরকার। সংসদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী।
এই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, ‘সামাজিক শক্তি বিলীন হয়ে গেছে। উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করি না। অন্যায়গুলো বড় হতে হতে এ জায়গায় পৌঁছেছে।’
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে। সরকার আইন করে, কিন্তু তা কার্যকর হয় না।
আলোচনায় ধারণাপত্র পাঠ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সংবিধানের মূল নীতি প্রতিস্থাপন করেছে। কিন্তু সমাজে তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কি না, সেটা বিবেচনার বিষয়। দেশে গত দেড় দশকে অবকাঠামো ও সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও ব্যয়বহুল উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভিযোগ আছে, অনেক প্রকল্পে বাংলাদেশ অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করেছে।
সারওয়ার আলী বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম, সামাজিক কিছু প্রবণতা হতাশা এবং গভীর শঙ্কার জন্ম দেয়।
সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে সারওয়ার আলী বলেন, তিন বছর ধরে নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা আয়োজন প্রমাণ করেছে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক শক্তির সহায়তায় এটি সম্ভব। কিন্তু সমাজে ধর্মবিদ্বেষ বেড়েছে। বর্তমান সরকার উগ্রবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও রাশ টেনে ধরে না এবং সমঝোতা বা সামলে চলে।
সারওয়ার আলী বলেন, লোভের কারণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ঋণখেলাপি বেড়েছে, তারল্যসংকট, রিজার্ভের সমস্যা বিপদের ইঙ্গিত করে। সব পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে মানুষ দিশাহারা। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। সরকার এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না। তিনি আবারও ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানান।
মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বলেন, অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডলার-সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা যাবে না। তাঁর আশঙ্কা, সরকার বাজারব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি না হলে উন্নয়ন হয় না। প্রবৃদ্ধি জনগণের টাকা খরচ করে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তের মানুষ কষ্টে আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আনোয়ার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সচেতন হোন। সারা দিন বঙ্গবন্ধুর নাম জপলেও তাঁর পথে কেউ চলে না।’ তিনি বলেন, দেশটি সব মানুষের হওয়া প্রয়োজন।
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আর এম দেবনাথ বলেন, টাকা পাচার হচ্ছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। কেউ কেউ একাই একাধিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হচ্ছেন। সরকার-ঘনিষ্ঠরাই এখানে ব্যবসা করছেন এবং টাকার মালিক হচ্ছেন।
বর্তমান এই ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে, তার জন্য নাগরিক সমাজও দায়ী উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ দেবনাথ বলেন, নাগরিক সমাজ এখনো বিভক্ত। দেশ বড় বিপদের দিকে যাচ্ছে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের আরও বক্তৃতা করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ।
আলোচনা সভার শুরুতে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন শাহীন আক্তার। এ ছাড়া বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।