১০ গুণ বেশি দামে মশার ওষুধ কিনেছে ডিএনসিসি
ডিএনসিসি তিন হাজার কেজি নোভালুরন-০.৮পি মাত্রার ওষুধ কেনে জেনেটিকার কাছ থেকে।
একই পরিবারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ গুণ বেশি দামে মশা মারার ওষুধ কিনেছে। বাজারমূল্য যাচাই থেকে শুরু করে দরপত্র প্রক্রিয়া—সব ক্ষেত্রে অনিয়ম করা হয়েছে। এই অনিয়মে ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিএনসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে।
মশা মারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ জেনেটিকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে তিন হাজার কেজি নোভালুরন-০.৮পি মাত্রার ওষুধ কেনে। দাম ধরা হয় প্রতি কেজি ২১ হাজার ৬৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ওষুধটি আমদানি করে সরবরাহে সব মিলিয়ে কেজিতে খরচ (সব খরচ, কর, লাভসহ) হয় মাত্র ২ হাজার ১১৪ টাকা। সেই হিসাবে ৩ হাজার কেজিতে খরচ ৬৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা। অথচ এ ওষুধ ডিএনসিসি কিনেছে ৬ কোটি ৩২ লাখ ৪ হাজার টাকায়।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে কি না, তদন্ত করে দেখা হবে।
১০ গুণ বেশি দাম
কাস্টম হাউস ঢাকার নথি অনুযায়ী, জেনেটিকা কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে যুক্তরাজ্য থেকে ৫০০ কেজি নোভালুরনের একটি চালান আনে। এতে জেনেটিকার ব্যয় হয় ৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৭৬ টাকা। ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৭৯ টাকা শুল্কসহ মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫৫ টাকা।
সিটি করপোরেশন পণ্যের ওপর ৭ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নিয়ে থাকে। এই ভ্যাট যুক্ত করা হলে ব্যয় দাঁড়ায় ৯ লাখ ৬০ হাজার ৮১১ টাকা। এর সঙ্গে সরবরাহকারীর জন্য নির্ধারিত ১০ শতাংশ লাভসহ মোট মূল্য দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯৩ টাকা। এই হিসাবে নোভালুরনের প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ২ হাজার ১১৪ টাকা। কিন্তু ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতি কেজি নোভালুরনের জন্য ২১ হাজার ৬৮ টাকা করে দিয়েছে, যা মোট মূল্যের চেয়ে ১০ গুণ বেশি।
অভিযোগের বিষয়ে জেনেটিকার মালিক আশমিতা ইরাদ আলী ই-মেইলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত দরপত্রে কাজটি পায়। দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়নি।
বাজারদর যাচাই ও দরপত্রে যোগসাজশ
নোভালুরনের বাজারদর যাচাইয়ে ডিএনসিসির সহকারী ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রাহাত আল ফয়সাল গত বছরের ৫ নভেম্বর চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দর চেয়ে প্রস্তাব পাঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো চট্টগ্রামের মদিনা ইনডেন্টিং লিমিটেড ও জেসকো সলিউশন, ঢাকার এঅ্যান্ডআই গ্রুপ ও চেরি ইনকরপোরেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের কারোরই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে কীটনাশক আমদানির অনুমোদন ছিল না।
প্রস্তাব চাওয়ার তিন দিন পর মদিনা ইনডেন্টিং প্রতি কেজি নোভালুরনের জন্য দর দেয় ২০ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া জেসকো ২১ হাজার ৭০০ টাকা, এঅ্যান্ডআই গ্রুপ ২২ হাজার ৩০০ টাকা ও চেরি করপোরেশন ২৩ হাজার ১০০ টাকা দর প্রস্তাব দেয়।
এসব প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতি কেজি নোভালুরনের জন্য ২১ হাজার ৭৯৫ টাকা নির্ধারণ করে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বান করে ডিএনসিসি। এতে অংশ নেয় জেনেটিকা, মদিনা ইনডেন্টিং ও জেসকো সলিউশন। জেনেটিকাকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়।
দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, মদিনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এম হাকিম আলী। তিনি জেনেটিকার মালিক আশমিতার স্বামী মোহাম্মদ ইরাদ আলীর বাবা। ইরাদ আলীর ভিজিটিং কার্ডে দেখা যায়, তিনি জেনেটিকা, হোটেল আগ্রাবাদ, এঅ্যান্ডআই গ্রুপ ও ইন্ট্রাকো গ্রুপের মালিক।
প্রতিষ্ঠানগুলো যে একই মালিকানাধীন, তা স্পষ্ট হয় নোভালুরন সরবরাহের চালানের নথিতে। মদিনা ইনডেন্টিংয়ের হয়ে দর প্রস্তাবে সই করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক। আবার তিনিই জেনেটিকার হয়ে নোভালুরন সরবরাহের চালানে সই করেন। জেনেটিকা ও মদিনা ইনডেন্টিংয়ের ঢাকার কার্যালয়ের ঠিকানাও একই।
তবে বাজারদর যাচাইয়ের বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক রাহাত আল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দর প্রস্তাব চেয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানগুলো দর প্রস্তাব দিতে চায়নি।
এটা পুরোপুরি যোগসাজশপূর্ণ দরপত্র প্রক্রিয়া। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী, এখানে কয়েকটি অপরাধ হয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করতে হবে।সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দরপত্র আহ্বানকারী, অর্থাৎ প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার। মূল্যায়ন কমিটি শুধু প্রতিষ্ঠানগুলো কে কত দর দিল, কোন প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দর দিল, সেসব যাচাই করে।
তবে দরপত্র আহ্বানকারী ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
এ বিষয়ে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, এটা পুরোপুরি যোগসাজশপূর্ণ দরপত্র প্রক্রিয়া। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী, এখানে কয়েকটি অপরাধ হয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করতে হবে।