নির্বাচনী সংঘাত
৯ স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের ওপর হামলা
প্রচারণায় নেমে নওগাঁর রানীনগরে স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর স্ত্রী ও কর্মী-সমর্থকেরা অবরুদ্ধ। পটুয়াখালীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের দোকানে ভাঙচুর, লুটপাট।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার নবম দিনে গতকাল মঙ্গলবার দেশের কয়েকটি স্থানে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, মারধর, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে। পাঁচ সংসদীয় আসনের ৯টি স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা, ধাওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে তিন স্থানে। আর দুই জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে গুলি ও নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
প্রচার চালানোর সময় নওগাঁর রানীনগরে স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর স্ত্রী ও কর্মী-সমর্থকদের নৌকার সমর্থকেরা অবরুদ্ধ করে রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর জের ধরে স্বতন্ত্র ওই প্রার্থীর আরও দুই সমর্থকের ওপর পৃথক হামলা হয়।
গত সোমবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত ১০টি আসনের ১৪টি স্থানে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ২৬ জন আহত হয়েছেন। নির্বাচনের প্রচার শুরু হয় ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯ দিনে ৭৫টি স্থানে সংঘাতের ঘটনা ঘটল।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারে হামলা
নওগাঁ-৬ (রানীনগর ও আত্রাই) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুক ওরফে সুমনের নির্বাচনী প্রচারে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ওপর একাধিক হামলার খবর পাওয়া গেছে। সোমবার সন্ধ্যার পর রানীনগর উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড, হাসপাতাল এলাকা, কাশিমপুর ও জিয়ানীপাড়া এলাকায় পৃথক এসব হামলার ঘটনা ঘটে। নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেনের সমর্থকেরা হামলাগুলো চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ওমর ফারুক। এসব ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা করেছেন দুই প্রার্থী।
ওমর ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। আনোয়ার হোসেন রানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ আসনে মোট পাঁচ প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সোমবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হওয়া চার দফা হামলায় আহত হয়েছেন ছয়জন। গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেন, আবদুল মালেক ও মাহাবুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যরা রানীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ওমর ফারুকের স্ত্রী কুরাতুল আইন কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন। এ সময় নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাহিদ ও তাঁর লোকজন কুরাতুল আইন ও কর্মী-সমর্থকদের ঘেরাও করে ফেলেন। খবর পেয়ে স্ত্রী ও কর্মী-সমর্থকদের উদ্ধার করতে ওমর ফারুক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সেখানে যান। এ সময় নৌকার সমর্থক নেতা-কর্মীরা লাঠি ও লোহার রড দিয়ে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে আঘাত করার চেষ্টা করেন। আঘাত ঠেকাতে গিয়ে ওমর ফারুকের কর্মী মাহবুর, মোশাররফ ও ফারুক আহত হন।
ওই ঘটনার জের ধরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এবং রাত আটটার দিকে জিয়ানীপাড়া এলাকায় দুই সমর্থকের ওপর পৃথক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কর্মী-সমর্থকেরা ট্রাকের কর্মী-সমর্থকদের ওপর কোনো হামলা করেনি।’
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ারের সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের ঝাউদিয়া বাজারে এই হামলার ঘটনা ঘটে। নৌকার কর্মীরা এই হামলা করেছেন বলে ঈগলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। এই আসনের নৌকার প্রার্থী টানা দুবারের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
হামলায় আহত বুলবুল আহম্মেদ ওরফে সাগর (২৪) নামের এক কর্মীকে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। এ ছাড়া সোমবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভেঙে সেখানে নৌকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নৌকার কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুকউজ্জামান।
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে নৌকার প্রার্থী শামীম ওসমানের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বাধা, হামলা ও ভাঙচুর এবং কর্মীদের মারধরের লিখিত অভিযোগ করেছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আলী হোসেন। গতকাল দুপুরে আসনটির নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজের কাছে এ লিখিত অভিযোগ দেন সোনালী আঁশের এই প্রার্থী।
আলী হোসেন উল্লেখ করেন, সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার বটতলা রেললাইন এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা। এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শামীম ওসমানের ১০-১২ জন সমর্থক প্রচারণায় বাধা দেন। প্রচারে ব্যবহৃত মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় মাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কর্মী ও অটোরিকশাচালককে মারধর করা হয়। এলাকায় নৌকা ছাড়া আর কোনো প্রতীকের প্রচার-প্রচারণা চালানো যাবে না বলে হুমকি দেন তাঁরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে কিছু করে থাকলে খোঁজ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও সিটির একাংশ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিমের নির্বাচনী পথসভায় নৌকার কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের গাছবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। হামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাঁচ সমর্থক আহত হয়েছেন। এই আসনে নৌকার প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তবে অভিযোগটি সত্য নয় দাবি করে নৌকার কর্মী ফারুক হোসেন বলেন, ‘তারাই আমাদের মাইক ভাঙচুর করেছে। আমাদের কয়েকজনকে মারধরও করেছে।’
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনের গলাচিপার বকুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের পাতাবুনিয়া শরীফবাড়ি ব্রিজ বাজারের এক ব্যবসায়ীর দোকানে নৌকার প্রার্থী এস এম শাহজাদার সমর্থকেরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর অভিযোগ, তাঁর দোকানে মাইক ও সাউন্ডবক্স রেখে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেনের লোকজন প্রচার চালাতেন। এ কারণে নৌকার লোকজন সোমবার রাতে তাঁর দোকানে হামলা চালিয়েছেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম শাহজাদাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
নৌকার কার্যালয়ে হামলা
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার একটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কার্যালয় লক্ষ্য করে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে উপজেলা সদরের পিআরপুর মোড় বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সরকার ও নির্বাচনবিরোধী লিফলেট বিতরণ করতে না দেওয়ায় তাঁরাই গুলি করেছেন এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে ঈশ্বরদী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা এমন কোনো ঘটনা ঘটাননি। বিএনপিকে চাপে রাখতে কেউ নিজেরাই গুলি ছুড়ে ও ককটেল ফাটিয়ে এখন দোষ চাপাচ্ছেন।
মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মকবুল হোসেনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী আবু সালেহ মোহাম্মদ নাজমুল হকের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে উপজেলার আড়পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
পাল্টাপাল্টি হামলা, ভাঙচুর
রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনের নৌকার প্রার্থী রাশেক রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাকির হোসেন সরকারের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৬ জন কর্মী আহত হয়েছেন বলে জাকির হোসেন দাবি করেছেন। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উপজেলার জায়গীর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনা জানাজানি হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা জড়ো হয়ে ঘটনার প্রতিবাদে বিকেল পাঁচটার দিকে জায়গীরহাট এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পুলিশের হস্তক্ষেপে তাঁরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন।
জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে নৌকার প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সমর্থকেরা একে অপরের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় ও রাতে সরিষাবাড়ী পৌরসভার শিমলাপল্লী তাড়িয়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন।
ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের কর্মী-সমর্থকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলাসহ নানা বিষয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন। সোমবার এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে ফরিদপুর শহরের পুলিশ লাইনস-সংলগ্ন হাবেলি গোপালপুর এলাকায় নৌকার সমর্থকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছেন এবং তাঁর কর্মী-সমর্থকদের মারধর এবং তাঁদের জীবননাশের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দুই সমর্থক কামরুল মোল্লা ও সেলিম শেখ আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার রাত নয়টার দিকে ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় আহত সেলিম শেখের বোন রাশেদা বেগম বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১০-১৫ জনকে আসামি করে গতকাল কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]