ঢাকার যে হাসপাতালে বিনা মূল্যে মিলছে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা-ওষুধ
ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ৬টা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মেঘ বারবার গর্জন করে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছে। ভারী বৃষ্টির কবলে পড়ে ব্যাপক ভোগান্তি এড়াতে ঢাকাবাসী দ্রুত নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটছে।
গত ৫ অক্টোবর বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় নগরবাসীর এই ছোটাছুটির মধ্যে রাজধানীর তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেল, এক ভিন্ন দৃশ্য।
কমপ্লেক্সের ভেতরে পৃথক কক্ষের সামনে নারী-পুরুষ-শিশু রোগীর সারি। একেক করে রোগী চিকিৎসাকক্ষের ভেতরে যাচ্ছেন। চিকিৎসক সময় নিয়ে রোগী দেখছেন। রোগীকে চিকিৎসাপত্র দিচ্ছেন। চিকিৎসাপত্রের সঙ্গে ছোট ছোট কাগজে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন চিকিৎসক। এই কাগজ দেখিয়ে কমপ্লেক্স থেকেই ওষুধ নিচ্ছেন রোগী।
তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ২৬ জুলাই বিনা মূল্যে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু হয়। নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের এই নতুন উদ্যোগের আওতায় এখানে রোগীরা ওষুধসহ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন বিনা মূল্যে।
বর্তমানে সারা দেশের মধ্যে শুধু তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই বিনা মূল্যে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। এই সেবা নিতে এখানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগী আসছেন।
কমপ্লেক্সে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী রোগীর সংখ্যা প্রতি মাসেই বাড়ছে। কমপ্লেক্সটির মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, গত আগস্টে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন ৬৪৭ রোগী। সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৪৭ জন সেবা নিয়েছেন। অক্টোবরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০৮ জন, নারী ৭৯৮ জন, শিশু ৩৮৬ জন।
কমপ্লেক্সে সম্প্রতি বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসেছিলেন সুমি আক্তার নামের এক নারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানকার চিকিৎসকেরা খুব যত্ন নিয়ে রোগী দেখেন। আবার প্রয়োজনীয় ওষুধও দিয়ে দেয় হাসপাতাল।
মো. কাজল নামের আরেক পুরুষ রোগী বলেন, কোনো সরকারি হাসপাতালে এমন সেবা পাওয়া যায়, তা তিনি আগে ভাবতে পারেননি। অনেক জায়গায় টাকা খরচ করেও এমন সেবা পাওয়া যায় না।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পাশেই পরিপাটি, সাজানো-গোছানো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এখানে দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা জানান, একতলা টিনশেড কমপ্লেক্সের সকালের পালার নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৮টায়। চলে বেলা ২টা পর্যন্ত।
হাসপাতালটির কার্যক্রম পুরোপুরি বহির্বিভাগভিত্তিক (আউটডোর)। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন বহির্বিভাগ চালু থাকে। বহির্বিভাগে নারী, পুরুষ, শিশুদের (৬-১৩ বছর) পৃথকভাবে সাধারণ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি গাইনি-প্রসূতি, অসংক্রামক ব্যাধি, অসুস্থ শিশুর (১-৫ বছর) সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, দন্তরোগ, জরায়ুমুখ-স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং-প্রতিরোধে ভায়া, বিকল্প চিকিৎসাসেবা বহির্বিভাগ থেকে দেওয়া হয়।
হাসপাতালটিতে জরুরি বিভাগ আছে। সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগ চালু থাকে।
কমপ্লেক্সটির মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে এখানকার সকালের পালায় বিভিন্ন বিভাগে ১১ হাজার ৪৮৯ রোগী সেবা নিয়েছেন। ১১ হাজার ৭৫৮ রোগী সেবা নিয়েছেন অক্টোবরে। সেপ্টেম্বরে জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬৫১ রোগী। অক্টোবরে ৬১৭ রোগী।
হাসপাতালটিতে পরীক্ষাগার আছে। এখানে রক্ত-মূত্রের ১৫ ধরনের পরীক্ষা (ল্যাব টেস্ট) করা হয়। হাসপাতালে ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা আছে। সব ধরনের পরীক্ষার জন্য সরকার নির্ধারিত ফি রাখা হয়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, কমপ্লেক্সে বিনা মূল্যে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয় বেলা আড়াইটায়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কার্যক্রম চলে। বহির্বিভাগভিত্তিক এই কার্যক্রমে নারী, পুরুষ ও শিশুদের পৃথকভাবে তিনজন চিকিৎসক নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দেন। তাঁদের মধ্যে দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
হাসপাতালটির মেডিসিনবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুরেশ কুমার নন্দী বলেন, ‘বৈকালিক পালায় রোগীর ভিড় থাকলে আমরা নির্ধারিত সময়সীমার (সন্ধ্যা ছয়টা) পরও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিই না।’
সকাল-বিকেল উভয় পালায় রোগীদের কমপ্লেক্সের ওষুধ বিতরণকেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়া হয়। কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে প্রতিবার রোগীদের ৩ থেকে ৫ দিনের ওষুধ দেওয়া হয়। আর ডায়বেটিস, রক্তচাপ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগের রোগীদের একবারে দেওয়া হয় এক মাসের ওষুধ।
হাসপাতালটিতে বর্তমানে ২০ চিকিৎসক কর্মরত আছেন। তাঁরা সকাল-বিকেল পালায় রুটিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া নার্স আছেন ১৫ জন। ধাত্রী (মিডওয়াইফ) চারজন। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও) ১৯ জন। স্বাস্থ্য পরিদর্শক একজন। স্বাস্থ্য সহকারী একজন।
হাসপাতালটির সহকারী সার্জন মাহমুদা আক্তার বলেন, গত প্রায় এক বছরে কমপ্লেক্সের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এখন প্রায় দ্বিগুণ। এখানে তেজগাঁও এলাকার বাইরে থেকেও অনেক রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন।
‘মডেল প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই’
তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গাজী আহমাদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এক বছরের কিছুটা বেশি সময় আগে এখানে দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালটিতে নিয়মশৃঙ্খলায় ঘাটতিসহ বেশ কিছু সমস্যা, সংকট ছিল। তবে সবার সহযোগিতায় এগুলোর যথাসম্ভব সমাধান করা হয়েছে। কমপ্লেক্স এলাকার অবৈধ বসতি-স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। নতুন সাজে কমপ্লেক্সকে সজ্জিত করা হয়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। জরুরি বিভাগ সুসজ্জিত করা হয়েছে। পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ ও আধুনিক করা হয়েছে। এখন চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী সময় মতো হাসপাতালে আসেন। তাঁরা অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে রোগীর সেবায় কাজ করেন।
গাজী আহমাদ হাসান আরও বলেন, ‘সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একমাত্র এখানেই বিনা মূল্যে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু রয়েছে। এই হাসপাতালের সেবার দরজা সবার জন্য খোলা। সেবার মাধ্যমে এই কমপ্লেক্সকে সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’