মাথায় বোঝা নিয়ে হাঁটার সময় মানুষের চলার গতির ছন্দ আলাদা হয়। ভারসাম্য রাখতে দ্রুত ছোটে তখন মানুষ। কারওয়ান বাজারে বোঝা বয়ে চলেন এমন কয়েক শ মানুষের মধ্যে মতিন সরকারকে দেখা যায় ভিন্ন। চারপাশের সব ব্যস্ততা উপেক্ষা করে মাথায় তেল দিয়ে, সিঁথি কেটে বসে ছিলেন তিনি। পায়ের ওপর পা তুলে গুনগুন করে গানও গাইছিলেন। চোখের সামনে ট্রাক থেকে তখন রসুন, আদার বড় বড় বস্তা নামিয়ে মাথায় করে গুদামের দিকে যাচ্ছিলেন অন্যরা। তাতে মতিন সরকারের কোনো হেলদোল নেই। এভাবে নির্বিকার হয়ে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘আজকে ছুটি দিছি নিজেরে। আরাম করতাছি।’
কারওয়ান বাজারের মিন্তি মতিন সরকারের বয়স এখন পঞ্চান্নর বেশি। ৩০ বছর ধরে তিনি এখানে থাকেন। তাঁর ধারণা, কারওয়ান বাজারে মালামাল বহনের শ্রমিক আছে দেড় থেকে দুই হাজার। এখানে এই শ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে কোনো জরিপ নেই। তবে মতিন তাঁর তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করেন, সংখ্যাটা এমনই হবে।
২১ আগস্ট সন্ধ্যায় ওই আলাপচারিতায় মতিন সরকার বললেন, বর্তমানে কারওয়ানবাজারে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তির দিকে; তাই মজুরি বাড়ছে না। ১০ বছর আগে যে বোঝা নিলে ২০ টাকা দিত, এখন তা মাত্র ১০ টাকা বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে।
২০২১ সালের ৮ মে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সমীক্ষার ফলাফলে জানিয়েছিল, করোনা মহামারির সময় পোশাক কারখানা থেকে চাকরি হারানো শ্রমিকদের ২০ শতাংশ দিনমজুর হয়েছেন। ‘করোনায় তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট জবাবদিহিতা’ শীর্ষক এক সংলাপে বলা হয়, নতুন কাজে শ্রমিকদের আয় কমেছে। আগে যেখানে শ্রমিকেরা মাসে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করতেন, সেখানে চাকরি হারানোর পর নতুন কাজে তাঁরা মাসে গড়ে সাত হাজার টাকা আয় করেন।
নতুন মিন্তি হয়ে কিছুটা টালমাটাল অবস্থায় আছেন রূপগঞ্জের মালেক মিয়া। তিনি ছিলেন খিলক্ষেতে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। তিনি বলেন, দেড় বছর হলো মিন্তির কাজ করছেন এই বাজারে। তবে মাঝেমধ্যে মালামালসহ টুকরির ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হয়। বড় টুকরিতে চাইলে ৫০ কেজিও নেওয়া যায়। দুইবার পা পিছলে হোঁচট খেয়ে কোমরে টান লেগেছে তাঁর।
মালেক মিয়া জানান, মিন্তিদের নির্দিষ্ট শ্রমমূল্য নেই। খুশি হয়ে তাঁকে যা দেওয়া হয়, তা–ই নেন। তবে খারাপ ব্যবহার করা মানুষ আছে অনেক। অনেক বোঝা গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে মাত্র ২০ টাকা ধরিয়ে দেন হাতে। দর-কষাকষির উপায়ও নেই। একজন না নিলে অন্য আরও দুজন নেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। দিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় হয় মালেক মিয়ার।
কারওয়ান বাজারে বোঝা বহন করা দিনমজুর শ্রমিকদের দুটি ভাগ আছে। একদল ট্রাক থেকে বস্তা নামিয়ে আড়তে পৌঁছে দেন। তাঁদের বলা হয় ‘আনলোডের কুলি’। আর বাজার করতে আসা ক্রেতার মালামাল দোকান থেকে নিয়ে বাহনে পৌঁছে দেওয়া শ্রমিকেরা হচ্ছেন মিন্তি।
বাঁশের টুকরিতে মালামাল নেওয়া মিন্তিদের চেয়ে আবার আনলোড শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বেশি। তাঁদের সরদার আছে। তিনি মজুরি নিয়ে ট্রাকমালিকদের সঙ্গে দাম–দর নির্ধারণ করেন। কোনো ঝামেলা হলে সামনে এসে দাঁড়ান। তাই তাঁকেও আবার এই শ্রমিকদের আয়ের নির্দিষ্ট ভাগ দিতে হয়। এদিক থেকে মিন্তিরা স্বাধীন।
তবে দুই ধরনের শ্রমিকদেরই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কারওয়ান বাজারে একই রকম। অনেকেই থাকেন আশপাশের এলাকায়। একটি দল থাকে বাজারেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আঞ্চলিক কার্যালয় (অঞ্চল-৫) ভবন এবং কিচেন মার্কেটসহ কয়েকটি জায়গায় রাতে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। ত্রিপল বিছিয়ে দেওয়া হয়। এক ঘুমের দাম ৩০ টাকা। গোসলসহ বাথরুম ব্যবহার ২০ টাকা। গোসল না করলে ৫ টাকা।
মতিন সরকারের ছুটির দিন টুকরি ভাড়া নিতে হয়নি। এত বছর থেকেও একটা টুকরি কিনতে পারেননি কেন জানতে চাইলে বললেন, দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই টাকা আয় করতে হয় গতর খেটে। যেদিন কাজ হয় না, সেদিন তো আর দরকার নেই; বরং রাখা ঝামেলা।
কারওয়ান বাজারের কোনো মিন্তিই নিজের জন্য টুকরি কেনেন না; বরং কাজ না থাকলে এই টুকরির ভেতর নিজের টুকরো জীবনটা গুঁজে দিয়ে ঘুম দেন। শনিবার রাতে এ রকম টুকরির ভেতর শুয়ে থাকতে দেখা গেল সাদেক নামের একজনকে। তিনি জানান, ১০টার সময় টুকরি ভাড়া নিয়েছে সকাল পর্যন্ত। সাড়ে ১০টার দিকে কাজ শুরু করবেন। তার আগে আরাম করে নিচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার আবদুর রাজ্জাক আনলোডের কুলি। বয়স ৬০ অতিক্রম করেছে। মাথায় একসঙ্গে বোঝা নিতে পারেন ৭৫ কেজির বেশি। মাথায় রসুনের তিনটি বড় বস্তা দেখা গেল। ৪০ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে থাকেন। বাড়িতে তেমন যাওয়া হয় না। তিনি জানান, প্রতি ১০০ টাকা আয়ে সরদারকে ৩০ টাকা দিতে হয় বলে তাঁর মনোবেদনা আছে।
২০২১ সালের জুলাইয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ( পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) তাদের এক জরিপে দেখিয়েছে, করোনার আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। মতিন সরকার বা আবদুর রাজ্জাকেরা এ হিসাবের আগে থেকেই দরিদ্র। নতুন তালিকার মধ্যে পড়েন মালেক মিয়া।
মিন্তিদের এই ভিড়ে কিছুটা আয়েশ আছে টুকরি ভাড়া দেওয়া মালিকদের। তাঁদের একজন আজহার। কারওয়ান বাজারের কুমড়াপট্টিতে যেখানে ট্রাকচালকেরা দুপুরে ভাতঘুম দেন, সেখানে মাঝেমধ্যে তিনি নিজের টুকরি রাখেন। তিনি জানান, প্রায় দেড় শ টুকরি আছে তাঁর। সব কটি যে রোজ ভাড়া হয়, এমন না। বড় টুকরি ৩০ টাকা আর ছোটগুলো ১৫ টাকায় ভাড়া হয়।
কারওয়ান বাজারে মিন্তিদের খোঁজখবর নিয়ে ফেরার পথে আবার দেখা মতিন সরকারের সঙ্গে। একটি ভ্যানের ওপর আধশোয়া হয়ে গল্প করছিলেন আরেকজনের সঙ্গে। আজ তাঁর স্বঘোষিত ছুটি চলছে। এত মানুষ কাজ করছে, আপনি তো আজ কিছুই পেলেন না—এসব কথা শুনে বললেন, ‘নিজেরে মাঝেমধ্যে ছুটি দিতে হয়। আরামের দরকার আছে। শোনেন, নিজেরে রাজা বা ফকির যা ভাববেন, আপনি তা–ই। আজকে কাজের মুড নাই।’