মহাখালী-নিকেতনে বিএনপির ময়লা-বাণিজ্যে সন্ত্রাসী ‘বিকাশ’ আতঙ্ক, স্থবির বর্জ্য সংগ্রহের কাজ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন ২০ নম্বর ওয়ার্ডে (মহাখালী–নিকেতন) ময়লা–বাণিজ্য (বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ) নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছির। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর এ কাজের নিয়ন্ত্রণে হাতবদল হয়েছে। ওয়ার্ডটিকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে কাজটি নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছেন বিএনপির নেতারা।

তবে হঠাৎ এ বাণিজ্যে বাগড়া দিয়েছে কয়েকটি ‘ফোনকল’ ও কিছু হামলার ঘটনা। একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের (প্রকাশ-বিকাশ সহোদর) নামে ভিনদেশের একটি নম্বর থেকে কল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ময়লা সংগ্রহের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়। এরপর পরিচ্ছন্নতা ও ভ্যান সার্ভিসের কর্মীরা কাজে গেলে কয়েক দফা হামলা হয় তাঁদের ওপর। এতে তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।

মহাখালীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১ থেকে ২৪ অক্টোবর টানা চার দিন বর্জ্য সংগ্রহ বন্ধ ছিল। হয়নি রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া ও নালা পরিষ্কারের কাজও। বর্জ্য পচা গন্ধে দুর্ভোগে পড়েন বাসিন্দারা। রাস্তায়ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। এর আগে আরও দুদিন এভাবে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল।

গতকাল শনিবার মহাখালীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভ্যান সার্ভিস কর্মীরা কিছু এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। তবে দুপুর পর্যন্ত কিছু এলাকায় ময়লা সংগ্রহ করতে যাননি তাঁরা। ওয়ার্ডে (২০ নম্বর) নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও কাজ করছেন ভয়-আতঙ্ক নিয়ে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ডে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া ও নালা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত ছিল বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাল্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর স্বত্বাধিকারী ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য ফরিদ উদ্দিন। আর বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করতেন কাউন্সিলর মো. নাছিরের নিয়োজিত ভ্যানমালিকেরা। এ কাজের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের তত্ত্বাবধায়ক লাবু মিয়া।

৫ আগস্টের পর কাউন্সিলর নাছির আত্মগোপনে চলে যান। তখন বর্জ্য সংগ্রহের কাজের নিয়ন্ত্রণ নেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। এখন মহাখালী দক্ষিণপাড়া (ক-ব্লক) ও সাততলা বস্তি এলাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ বিল নেন ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান আক্তার; টিবি গেট ও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এলাকায় (চ ও ছ-ব্লক) নেন বনানী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক চান সরদার; তিতুমীর কলেজের দক্ষিণ পাশের এলাকায় (গ-ব্লক) বনানী থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম ও ওয়্যারলেস এলাকায় (জ-ব্লক) ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অলি উল্লাহ মিয়া।

তবে আগের মতোই ওই কাজের তদারকির দায়িত্বে আছেন মাল্টি ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক লাবু মিয়া। অবশ্য বিল আদায় করছেন বিএনপি নেতাদের নিয়োজিত কর্মীরা।

মাল্টি ইন্টারন্যাশনালের কয়েকজন কর্মী গতকাল প্রথম আলোকে জানান, ১৮ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে চ-ব্লক এলাকায় নালা পরিষ্কারের কাজ করছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মী কবির হোসেন ও মো. রুবেল। তখন অচেনা আট-দশজন এসে তাঁদের মারধর করেন ও কাজ বন্ধ করতে বলেন। পরবর্তী সময়ে কাজে এলে প্রাণনাশ করার হুমকি দিয়ে যান।

২২ অক্টোবর ভোরে মহাখালী স্কুল সড়কের দাদা হোটেল এলাকায় রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী মজনু ও শওকত আলী। হঠাৎ দুটো পিকআপে ১৫-২০ জন জিআই পাইপ, লাঠি, রড, দা হাতে আসেন। এ সময় মজনুর ডান হাতে একটি কোপ দেওয়া হয়। আর শওকতের মাথায় আঘাত করা হয় লাঠি-রড দিয়ে।

এ বিষয়ে মাল্টি ইন্টারন্যাশনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে হামলা ও এরপর কাজ বন্ধ রাখার বিষয় স্বীকার করেন তাঁরা।

এই কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘গত মাসের শুরু থেকেই দুটি অচেনা নম্বর থেকে কল করে সন্ত্রাসী বিকাশের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। কাজ বন্ধ রেখে তাঁদের সঙ্গে বসতে বলে। তাঁদের সঙ্গে না বসে কাজ করায় হামলা চালানো হয়েছে।’

একইভাবে ওই ওয়ার্ডে ভ্যান সার্ভিসের কাজ বন্ধ রাখতে লাবু মিয়াকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে লাবু কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে মাল্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যে দুটি নম্বর পাওয়া গেছে ওই নম্বরগুলোর বিষয়ে ৭ অক্টোবর বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বনানী থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অজ্ঞাত ওই দুটি নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে তাতে আমার ছবি ব্যবহার করে আমার নামে কল দিয়ে বিভিন্নজনকে হুমকি দিয়ে চাঁদা চাওয়া হয়েছে। না দিলে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই দফায় হামলা হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। এতে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ভ্যান সার্ভিসের কাজের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী যুক্ত থাকায় এমন হয়েছে বলে জেনেছি। ওই কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

ক্যাপ্টেন ফিদা হাসান আরও বলেন, ‘দরপত্রের মাধ্যমে ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হলে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সহায়তা করবে। আপাতত ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কাজটি চলমান রয়েছে।’