দুই হাতে ভর দিয়ে সিঁড়িতে বসে নূর ডাকেন মোহাম্মদপুর, ডেমরা, স্বপ্ন দেখেন বাসমালিক হওয়ার
বয়স ২৫ বা ২৬-এর মতো। তবে উচ্চতা দেখলে মনে হয়, চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী কোনো শিশু। জন্মগতভাবেই দুই পা বাঁকা এবং শক্তি নেই। নূর আলম নামের এই ব্যক্তি পেশায় বাসচালকের সহকারী। বাসে ওঠার প্রথম সিঁড়িতে বসে বাঁকা পা দুটো নিচের দিকে নামালে কোনোরকমে মাটি স্পর্শ করতে পারেন।
নূর আলম বাসের প্রথম সিঁড়িতে বসেই মোহাম্মদপুর, শংকর, রামপুরা, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার...বলে যাত্রীদের ডাকাডাকি করেন। তারপর দুই হাতে ভর দিয়ে বাসের ভেতর গিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তোলেন। অনেক যাত্রী নিজেরাই তাঁর হাতে ভাড়া দিয়ে নেমে যান।
এভাবে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নূর আলম বিভিন্ন বাসে সহকারীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এখন তিনি কাজ করছেন রমজান আলী এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে। গত সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে আবার সেখান থেকে ফিরতি পথে বাসে বসেই নূর আলমের সঙ্গে কথা হয়। কাজের ফাঁকে কথা বলেন তিনি।
পরের দিন নূর আলম কাজে যাননি, বছিলায় তাঁর তিনতলার মেসে বসেও কথা হলো। আরও কয়েকজনের সঙ্গে নূর আলম এখানে থাকেন। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় ওঠানামা কষ্টের কাজ হলেও অন্য কোথাও বাসা ভাড়া না পাওয়ায় সেখানে থাকতে হচ্ছে তাঁকে।
নূর আলম বলেন, এই জীবনে তিনি পায়ে কোনো জুতা পরতে পারেননি। বসলে দুই পায়ের পাতা ভাঁজ করে রাখতে হয়। দুই পায়ে শক্তি একেবারেই নেই। দুই হাতে ভর দিয়ে চলতে চলতে হাত দুটিও বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাসের সহকারীর দায়িত্ব পালনের সময় এক হাত দিয়ে শক্ত করে বাসের হাতল ধরে রাখেন, আরেক হাতে টাকা রাখেন। তাই হাত কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা বা হাতের নিচে কাঠের টুকরা দিয়ে চলাফেরা করাও সম্ভব হয় না।
বৃষ্টি হলে নূর আলম কাজে যেতে পারেন না। বেশি রোদ বা গরম পড়লেও বাসের সিঁড়িতে বসে কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। তাই সপ্তাহে কম করে হলেও দুই থেকে তিন দিন বা কখনো আরও বেশি দিন কাজ কামাই দিতে হয়।
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির দিন হাতে ভর দিয়া হাঁটা যায় না। যাত্রীদের পায়ে জুতা থাকে। জুতায় বৃষ্টির পানি ও কাদা নিয়া যাত্রীরা বাসে ওঠেন। সিঁড়ির জায়গা কাদায় মাখামাখি হয়। সেই কাদা আমার প্যান্ট ও শরীরে লাগে, তখন খুব কষ্ট হয়। আর বেশি রোদে সিঁড়িতে তো বসাই যায় না। যাত্রীর ভিড় বাড়লে ভাড়া তোলাও কঠিন হয়ে যায়। বাসের মধ্যে জায়গা থাকলেও যাত্রীরা দরজার কাছে দাঁড়ায় থাকলেও কাজে সমস্যা হয়।’
প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন
বাসে সহকারীর দায়িত্ব পালন করলেও নূর আলম বাস ঝাড়ু দিয়ে, লুকিং গ্লাস পরিষ্কার করা, চাকা খোলার মতো কাজগুলো করতে পারেন না। এসব কাজ করতে হয় বাসের চালককে। তবে এ জন্য নূর আলম মজুরি কম পান, তা নয়। বাসের আয় থেকে ভাগাভাগি করে যাঁর মজুরি যা আসে, তা-ই পান।
সোমবার বাসটি চালাচ্ছিলেন চালক রহমত সরদার। গত দুই মাসে নূর আলমের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই চালক বলেন, নূর আলম শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁর কিছু কাজ নিজেকেই করতে হয়। কাজের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা যে একেবারে হয় না, তাও নয়। রহমত সরদার বলেন, ‘আর যা-ই হোক, নূর আলম কাজ করে খাচ্ছে। ভিক্ষা তো করে না।’
মাঝেমধ্যে বাসে উঠতে গিয়ে নূর আলমকে দেখে কোনো কোনো যাত্রী বিরক্ত হন। কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করেন। নূর আলম ভিক্ষা না করে বাসে কেন কাজ করছেন, তা নিয়েও অনেকে গালমন্দ করেন। তবে নূর আলম কাজ করে খাচ্ছেন—বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখেন বেশির ভাগ যাত্রী। কেউ কেউ স্যালুটও জানান।
নূর আলম বলেন, ‘সব মানুষ তো আর এক রকম না। ভালা মানুষও আছে। যাত্রীর খারাপ আচরণে মন খারাপ হয়, আবার ভালো আচরণে মন ভালোও হয়।’।
বাসমালিক হওয়ার স্বপ্ন
নূর আলম বলেন, দিনে বাসের আয় কত হলো, সেই অনুযায়ী তিনি সেদিনের বেতন পান। আয় বুঝে তা এক হাজার টাকাও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। আর যেদিন কাজে যান না সেদিনের কোনো বেতন পান না। সরকারের কাছ থেকে তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা পান। নূর আলম বছিলায় যে মেসে ভাড়া থাকেন, সেখানে মাসে দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা।
সকালের নাশতা থেকে শুরু করে রাতের খাবার—সব বেলাতেই হোটেলের খাবারই ভরসা। নিজের হাত খরচের টাকা রেখে নোয়াখালীতে স্ত্রী হালিমা, সাত বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত এবং বৃদ্ধ মা-বাবার জন্যও কোনো মাসে পাঁচ হাজার টাকা, আবার কোনো মাসে তিন হাজার টাকা পাঠাতে পারেন। আবার কোনো মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেন না। এর মধ্যেও তিনি কিছু টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন। স্বপ্ন দেখেন কিস্তিতেও যদি একটি বাসের মালিক হতে পারতেন, তাহলে আর এত কষ্ট করতে হতো না। তবে এ স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কি না, তা তিনি জানেন না।
বাসের মালিক হতে পারলে কী করবেন, জানতে চাইলে নূর আলম বলেন, তখন তো আর বাসের সহকারীর কাজ করতে হবে না, বসে বসে শুধু তদারকি করলেই হবে।
বছিলার মেসে নূর আলম নিজের কাপড় ধোয়াসহ অন্যান্য কাজ একাই করেন। রশিতে কাপড় মেলতে পারেন না, তাঁর সঙ্গে অন্য যাঁরা থাকেন, তাঁরা এ কাজে সাহায্য করেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপ শেষে নূর আলম নিজেই ঘরের তালা লাগিয়ে হাতে ভর দিয়ে নিচে নামলেন।
সব মিলে কেমন আছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে নূর আলম বলেন, ‘ভালোই আছি। কাজ না করলে ভালো থাকন যাইব না। আমি মানুষের কাছে ভিক্ষা চাই না, তবে কোনো একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর লাইগ্যা বা বাস কেনার জন্য কেউ যদি কোনোভাবে সাহায্য করেন, তা নিতে আমার আপত্তি নাই।’
নূর আলম তাঁর আরেকটি স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি বললেন, মেয়ে জান্নাতকে তিনি চিকিৎসক বানাতে চান।