‘আপু তুমি ছেড়ে যেয়ো না, আমার ভয় লাগছে’
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সিলিন্ডারের গ্যাস থেকে লাগা আগুনে দিনমজুর মহিদুল ইসলামের (২৮) শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি মহিদুলের জন্য কান্নাকাটি করছিলেন তাঁর বোন ময়ূরী বেগম। তিনি বলেন, মহিদুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বৃদ্ধ মা-বাবাকে তিনি টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে সংসার চলছিল তাঁদের।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে কথা হয় ময়ূরী বেগমের সঙ্গে। আইসিইউতে মহিদুলকে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছেন বলে জানান তিনি। ময়ূরী বেগম বলেন, তিনি আইসিইউতে যাওয়ার পর একসময় মহিদুল অক্সিজেনের মাস্ক খুলে বলেন, ‘আপু, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমার ভয় লাগছে।’
মাহিদুলের মতো ওই ঘটনায় দগ্ধ আরও ৩১ জন চিকিৎসাধীন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনই শিশু। দগ্ধ সবার অবস্থাই খারাপ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের নিয়ে দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা।
আজ সকালে আইসিইউতে ছটফট করছিলেন পোশাকশ্রমিক লাদেন হোসেন (২২)। তাঁর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। নাকে–মুখে অক্সিজেনের নল লাগানো। স্ত্রী শারমিনকে কাছে পেয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলছিলেন, শরীরের জ্বালাপোড়া সহ্য করতে পারছেন না। তাঁকে যেন সেখান থেকে নিয়ে আসেন।
লাদেন হোসেনের স্ত্রী শারমিন আইসিইউ থেকে বের হয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গতকালের আগুনে তাঁর স্বামীর শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকায় শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। ওই বাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে পাশের একটি দোকান থেকে শফিকুল নিজেই একটি সিলিন্ডার কিনে আনেন। সেই সিলিন্ডার লাগানোর সময় সিলিন্ডারের চাবি খুলে গ্যাস বেরিয়ে পাশের চুলার আগুনের সংস্পর্শে এলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় আশপাশের উৎসুক নারী, পুরুষ ও শিশুদের শরীরে আগুন লেগে ৩৬ জন দগ্ধ হন।
আজ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলার আইসিইউ ও পঞ্চম তলার হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) সামনে দগ্ধ ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় দেখা যায়। তাঁদের অনেকে কান্নাকাটি করছিলেন। আইসিইউর সামনে লাদেন হোসেনের স্ত্রী শারমিন বলেন, তাঁদের দুই বছরের সন্তান রয়েছে। ঘটনাস্থলের পাশের একটি বাসায় তাঁরা স্বামী–স্ত্রী ভাড়া থাকেন। দুজনের আয়ে কোনোমতে সংসার চলছিল।
শারমিনের পাশেই বসে কাঁদছিলেন লাদেন হোসেনের বাবা আবদুর রহিম। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মাখনের চরে। নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। তিন ছেলের মধ্যে লাদেন সবার বড়। তাঁর আয়েই সংসার চলে। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, লাদেনের অবস্থা খারাপ। এ কথা শুনে তিনি কীভাবে ঠিক থাকবেন?
লাদেন ও মাহিদুল ছাড়াও এ ঘটনায় গুরুতর আহত আরও চারজন এই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সেখানে আজ এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, দগ্ধদের মধ্যে ১৬ জনের বেশি ব্যক্তির ৫০ শতাংশের বেশি পুড়েছে। ১০ জনের বেশি ব্যক্তির ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দগ্ধ সবার অবস্থাই খারাপ। সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।
এ ঘটনায় দগ্ধ শিশুদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী আছে সাতজন। আর ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৬ জন। শিশুদের শরীরের ১০ শতাংশ পুড়লেই গুরুতর বলে ধরে নেওয়া হয় বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় দগ্ধ স্কুলছাত্র গোলাম রাব্বির (১২) শরীরের ৯০ ভাগ পুড়েছে। তার বাবা আইসক্রিম বিক্রেতা শাহ আলম এখন দিশেহারা। তিনি গাজীপুরের কোনাবাড়িতে থাকেন। আজ হাসপাতালে রাব্বির ফুফু করুণা বেগম বলেন, দগ্ধ হয়ে সে ফুলে গেছে। তাকে চেনার উপায় নেই। শুধু চোখ দুটি দেখা যায়।
হাসপাতালে রাব্বির চাচা কোরবান আলীর সঙ্গে আজ কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, রাব্বির মা মারা যাওয়ার পর তাকে দত্তক নেন এক সেনা কর্মকর্তা। ওই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সে নাটোরে থাকে। পড়াশোনা করে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে। গত সপ্তাহে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গাজীপুরে এসেছিল সে। গতকাল আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর ওই সেনা কর্মকর্তাই তাকে নিজের গাড়িতে করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান।