জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল
পুষ্পস্তবকগুলো একটির পর আরেকটি শহীদ বেদিতে রাখা হচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক দলের পক্ষ-বিপক্ষ, কিংবা শ্রেণি-পেশা-নির্বিশেষে বিভিন্ন দল, সংগঠনের প্রতিনিধি ও ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আর নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্মরণ করছেন ভয়াল ও নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
রাজধানীর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আজ বুধবার ভোর থেকেই জড়ো হতে থাকে নানা বয়সী মানুষেরা। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় শ্রদ্ধা জানানো। শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে সর্বস্তরের মানুষ।
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে প্রথমে সকাল সাতটায় রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর সেখানে তাঁরা কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে উঠে। পরে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান। তিনি বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের ভোটাধিকার থাকবে, কথা বলার অধিকার থাকবে, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে এবং সেখানে মানুষ মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা এগুলোর সবকিছু হারিয়েছি। ইংরেজিতে যাকে বলে ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান, এ অবস্থায় আছি।’
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘১৯৭১–এর খুনিদের মুক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাই, কোনো দিন বিএনপি এমন ন্যক্কারজনক দাবি উত্থাপনের সাহস দেখায়নি। এবার বিজয় দিবসে এটা সবচেয়ে বড় লজ্জার কথা। আমি মনে করি ’৭৫–এ জিয়াউর রহমান, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং একাত্তরের হত্যাকারীদের, জামায়াত ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে যে পার্টনারশিপের সূচনা করেছিল, সেটাই বাংলাদেশকে রাজনৈতিক অশান্তির ভেতর ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক শান্তি চাইলে বিএনপির সাম্প্রতিককালে সাজাপ্রাপ্ত ’৭১–এর খুনীদের মুক্তির দাবিটা শোনার পরে তাদেরকে বর্জন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিএনপি যে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে, এটা লজ্জার ঘটনা।’
দুই বছরের ছেলে মশিউরকে কোলে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন মিরপুর লালকুঠির বাসিন্দা শেখ মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি মাছের ব্যবসা করি। কিন্তু এ দিনে বেচাবিক্রি বন্ধ। আগে নিজে একাই চলে আসতাম। এবার সন্তানকে নিয়ে আসলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে জাগ্রত করতে হবে। দেশের ইতিহাস জানা জরুরি। ইতিহাস না জানলে নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষ দেশকে ভালোবাসবে কীভাবে? শুধু গুরুত্বপূর্ণ দিবসেই নয়, যাঁরা এ সোনার বাংলা ও স্বপ্নের বাংলাদেশ আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির জায়গাগুলো সময় পেলেই আমাদের গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো উচিত।’
বাংলাদেশ মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রী বেবী বরুয়া বলেন, ‘সোনার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সবার একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক মুক্ত দেশ চাই, বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাক। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা জানুক এবং সেভাবে দেশকে ভালোবাসুক এই প্রত্যাশা।’
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক তানভীন সুইটি বলেন, ‘আমরা কি ’৭১ সালের সেই দিনের কথা ভুলে গেছি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়ে যাঁরা এ দেশেরই মানুষ ছিলেন, যাঁরা রাজাকার–আলবদর তাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যখন দেখেছেন বাংলাদেশের বিজয় হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। আর আজ তাঁরা অনেক বড় বড় কথা বলেন। তাঁদের এ কথাগুলো কেন আমরা বিবেচনায় আনব। তাঁদের এ কথাগুলো অর্থহীন। রাজাকার–আলবদররা যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, সেটা হাস্যকর মনে হয়। আর আমরা যাঁরা সচেতন নাগরিক আছি, তাঁদের এ কথাগুলো প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না।’
মিরপুরের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান এক ছেলে ও দুই জমজ মেয়েকে নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। ছেলে পঞ্চম শ্রেণির রামীন রহমান। আর মেয়ে ছয় বছরের বৃষ্টি ও মিষ্টি। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে প্রতিবছরই আসি। তবে মেয়ে দুজনকে এবারই প্রথম সঙ্গে করে নিয়ে আসলাম। ছেলে ও মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যখন শহীদ বেদিতে ফুল দিয়েছি, তখন শিহরিত হয়ে যাই। আমি চাই, আমার সন্তানদের মধ্যেও এই শিহরণের অনুভূতি জাগ্রত হোক। দেশের ইতিহাস জানুক, দেশকে ভালোবাসুক, দেশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হোক।’
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন বি এম এ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এনডিএফ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি এনপিপি, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ বিএসপিপি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, গণফোরাম, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তর, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা ফুল ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া অনেকেই ব্যক্তি ও পারিবারিকভাবে সন্তান ও স্বজনদের দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।