বিএনপিকে ‘নজরদারিতে’ রাখবে আওয়ামী লীগ
নির্বাচনী প্রচারের চেয়ে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করার কৌশল নিয়েই বেশি ভাবছে আওয়ামী লীগ।
রাজপথের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লাতেও বিএনপির কার্যক্রম একধরনের ‘নজরদারির’ মধ্যে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। এ অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারের চেয়ে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করার কৌশল নিয়েই বেশি ভাবছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপির সমাবেশ–মহাসমাবেশের দিন রাজপথে আওয়ামী লীগও থাকবে—এটি দলীয় সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগের এমন অবস্থান নেওয়ার কারণ বিএনপির প্রতিটি পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানানো। গত ডিসেম্বর থেকে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে আওয়ামী লীগ। তবে এখন সেটা রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি বড় শহর, এমনকি পাড়া–মহল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
গত দুদিন মহাসমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির ‘দর–কষাকষি’র সঙ্গে বারবার নিজেদের সমাবেশের (তারুণ্যের জয়যাত্রা) স্থানও বদলেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে সমাবেশ (বৃহস্পতিবার) করতে চেয়েছে তারা। কিন্তু গত বুধবার পুলিশ বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও নির্ধারিত স্থানে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। এরপর সমাবেশের স্থান হিসেবে গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সমাবেশের স্থান ঠিক করা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও দফায় দফায় বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের সামনেই সমাবেশের স্থান নির্ধারিত হয়। বিএনপির মহাসমাবেশ এক দিন পিছিয়ে আজ শুক্রবার করার পর আওয়ামী লীগও এক দিন পিছিয়ে একই দিনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা রাজপথে থেকেই ভোটের প্রস্তুতি নেব। রাজপথ ছেড়ে দিলে ভোট হবে কীভাবে? বিএনপি তো সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের মাধ্যমে ভোট ভন্ডুল করতে চায়। তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে না
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি রাস্তায় সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগও রাস্তায় সমাবেশ করবে—এমন সিদ্ধান্ত ছিল। বিএনপি যদি গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার বিষয়ে রাজি হতো, তাহলে আওয়ামী লীগও আগারগাঁওয়ের বাণিজ্য মেলার মাঠ বা অন্য কোনো মাঠে সমাবেশ করার ক্ষেত্রে আপত্তি তুলত না।। তবে সমাবেশ হতো একই দিনে।
এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাজপথে থেকেই ভোটের প্রস্তুতি নেব। রাজপথ ছেড়ে দিলে ভোট হবে কীভাবে? বিএনপি তো সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের মাধ্যমে ভোট ভন্ডুল করতে চায়। তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে না।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সূত্র বলছে, পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকায় একদিকে বিএনপিকে চাপে রাখা যাচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং প্রচারের কাজও হচ্ছে।
পাল্টা কর্মসূচির কৌশল ‘সফল’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র মনে করে, বিএনপির পদযাত্রা–সমাবেশের দিনে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ‘সফল’ হয়েছে।
ওই সূত্রগুলো বলছে, গত ডিসেম্বর থেকে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে না নামলে বিএনপি সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারত। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যেত। এখন বিএনপিকে রাজপথে মোকাবিলার পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও দলটির ওপর চাপ আসবে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সরকারের নীতিগত অবস্থান হচ্ছে বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে বাধা না দেওয়া। তবে প্রশাসনিক নানা ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দলটির ওপর চাপ আরও বাড়ানো হবে। সরাসরি সভা-সমাবেশে বাধা না দিলেও দলটির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে করা পুরোনো মামলাগুলো সচল করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি, নজরদারি ও গ্রেপ্তারের মতো তৎপরতা বাড়ানো হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা যাতে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতে না জড়ান, সেই নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির কর্মকাণ্ড দেখে প্রতিক্রিয়া ঠিক করা হবে।
বিএনপিও বিদেশিদের দেখাতে এই সময়ের মধ্যে বড় বড় সমাবেশসহ রাজপথে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে যাবে। এর মধ্যে ঢাকা ‘অচল’ করার চেষ্টাও করবে। তফসিল ঘোষণা হলে বিএনপি হয়তো ভোট ঠেকাতে ‘আক্রমণাত্মক’ কর্মসূচি দেবে।
রাজপথের কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে যুক্ত আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র মনে করে, বিএনপি সামনের দিনগুলোতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাও করার কর্মসূচি দিতে পারে। এমনকি রাজপথে লাগাতার অবস্থান নিয়ে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হনিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ভোট পণ্ড করতে চাইছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। আর আওয়ামী লীগও যেকোনো নৈরাজ্য মোকাবিলায় নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবে। সংবিধান মেনে ভোট আয়োজনে যা যা করণীয়, তা করবে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন আলোচনা আছে, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি ঠেকানোর চেষ্টা করবে—এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। এই পরিস্থিতিতে যথাসময়ে নির্বাচন করাই দলের মূল লক্ষ্য। দলটির নেতারা মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার (নভেম্বরের শুরুতে হতে পারে) আগপর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। বিএনপিও বিদেশিদের দেখাতে এই সময়ের মধ্যে বড় বড় সমাবেশসহ রাজপথে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে যাবে। এর মধ্যে ঢাকা ‘অচল’ করার চেষ্টাও করবে। তফসিল ঘোষণা হলে বিএনপি হয়তো ভোট ঠেকাতে ‘আক্রমণাত্মক’ কর্মসূচি দেবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সূত্র বলছে, পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকায় একদিকে বিএনপিকে চাপে রাখা যাচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং প্রচারের কাজও হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দলের সব কর্মসূচিতে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ব্যাপক ‘শোডাউন’(মহড়া) দেখা যাচ্ছে। সভা-সমাবেশগুলোতে সরকারের উন্নয়ন-অর্জনের স্লোগানসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসছেন নেতা-কর্মীরা। নৌকায় ভোট চাইছেন বক্তারা। এটা আসলে ভোটেরই প্রচার।
শোকের মাস আগস্টে সাধারণত রাজপথের বড় কর্মসূচির চেয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানসহ ঘরোয়া আয়োজন বেশি করে আওয়ামী লীগ। তবে এবার শোকের কর্মসূচিও রাজপথে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা ও সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে বিরোধীদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হওয়ায় রাজপথ দখলে রাখাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হলে রাজপথের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের কাছেই থাকতে হবে ।