নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতে ঢাবিতে ১১ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস এলাকায় গত শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষকের গাড়িচাপায় এক নারীর মৃত্যুর পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। সেই শঙ্কার জায়গা থেকে নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতে ১১ দফা দাবিতে মাঠে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরো ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। দাবি আদায়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে স্মারকলিপি দিয়ে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত শিক্ষক আজহার জাফর শাহের ব্যক্তিগত গাড়ির নিচে পড়ে আটকে যান রুবিনা আক্তার নামের এক নারী। পথচারীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও জাফর শাহ ওই অবস্থাতেই গাড়িটি নিয়ে চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত বেপরোয়া গতিতে ছোটেন। প্রচণ্ড চাপ ও আঘাতে গুরুতর আহত ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উত্তেজিত জনতা জাফর শাহকে গাড়িসহ আটকে গণপিটুনি দেয় এবং গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় নিহত রুবিনার ভাই জাকির হোসেন শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন।
শুক্রবারের ওই ঘটনার পর সেদিন সন্ধ্যায় নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ ও ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা-কর্মীরা এবং ছাত্রী হলগুলোর প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিসহ কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী। প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিসহ কিছু শিক্ষার্থী গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা সিটি করপোরেশনের অধীন থাকলে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আওতায় আনা, অবিলম্বে ক্যাম্পাসে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ যানবাহনের ক্ষেত্রে চলনসীমা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানোর দাবিতে উপাচার্য ও প্রক্টর বরাবর স্মারকলিপি দেন। উপাচার্য ও প্রক্টর দাবি বাস্তবায়নে তাঁদের আশ্বস্তও করেন।
এরপর আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতে ১১ দফা দাবি নিয়ে টিএসসি এলাকার রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা রাজু ভাস্কর্যের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়ায়, অন্য অংশ রাস্তায় বসে পড়ে। ‘ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরে, প্রশাসন কী করে’, ‘দাবি মোদের একটাই, নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’ বলে মুহুর্মুহু স্লোগান দেন তাঁরা। এ সময় চোখে-মুখে কালো কাপড় বেঁধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ জানান কয়েক শিক্ষার্থী। পরে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে (ভিসি চত্বর নামে পরিচিত) যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে সড়কের ওপর বসে কিছুক্ষণ স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর সেখান থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি ও শহীদ মিনার এলাকা হয়ে কার্জন হল এলাকায় যান তাঁরা।
কার্জন হল এলাকায় আন্দোলনের ১১ দফা দাবি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আল মেহরাজ শাহরিয়ার মিথুন। দাবিগুলো হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সব যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, শব্দদূষণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা ও শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা; রুবিনা আক্তার হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করা; ক্যাম্পাসে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রধান প্রবেশদ্বারগুলোয় দ্রুত চেকপোস্ট বসানো ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা; বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুধু নিবন্ধিত রিকশা চলাচল ও রিকশাচালকদের জন্য ইউনিফর্ম ও ভাড়ার চার্ট প্রস্তুত করা; ভ্রাম্যমাণ দোকানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ ও প্রশাসনের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা; প্রথম বর্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে আইডি কার্ড দেওয়া ও ক্যাম্পাসের কিছু স্থানে সংরক্ষিত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা; মাদকাসক্ত ও ভবঘুরে ব্যক্তিদের ক্যাম্পাস থেকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা; সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসকে সিসিটিভির আওতায় আনা ও ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা; প্রক্টর কার্যালয়ে জমে থাকা সব অভিযোগ নিষ্পত্তি করা; নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রক্টর কার্যালয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিগুলো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
আল মেহরাজ শাহরিয়ার মিথুন নামের ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই আন্দোলন হচ্ছে। গত পরশু ক্যাম্পাসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সেই জায়গা থেকে তাঁরা ভেবেছেন যে নিরাপদ ক্যাম্পাসের জন্য একটা আন্দোলন হওয়া দরকার। আমাদের ১১ দফা দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। এসব দাবিতে আমরা উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবিগুলো বাস্তবায়নে উপাচার্য কোনো পদক্ষেপ না নিলে বা কোনো প্রতিশ্রুতি না দিলে ১১ ডিসেম্বর থেকে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাব।’
পরে কার্জন হল থেকে মিছিল নিয়ে আবার টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে যান শিক্ষার্থীরা। মিছিলে ‘ক্যাম্পাসে রক্ত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘দাবি মোদের একটাই, নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’ প্রভৃতি বলে স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সাবেক ভিপি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জুলিয়াস সিজার তালুকদার (২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা। রাজু ভাস্কর্যের সামনে তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আজকের আন্দোলনের মতো স্বতঃস্ফূর্ত, সংগঠিত, অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আমি আমার ক্যাম্পাসজীবনে দেখিনি। তোমরা যে একটা উত্তাল স্রোতের সৃষ্টি করেছে, সেই স্রোতে এ ক্যাম্পাসের সব অরাজকতা ভেসে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’