ডেঙ্গু পরিস্থিতি
রোগী ও মৃত্যু বাড়ছে, তবু মশা নিধনে ঢিলেঢালা ভাব
রাজধানীতে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানোর পরামর্শ। ডেঙ্গুতে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৬৫ জনের মৃত্যু।
আট বছরের আবদুল্লাহ আয়াত ঘুমাচ্ছে। একই বিছানায় ১৩ বছরের হেলালুর রহমান জেগে থাকলেও চোখে–মুখে দুর্বলতার ছাপ। দুজনের হাতেই ক্যানুলা (ইনজেকশন ও স্যালাইন বারবার দেওয়ার ব্যবস্থা) লাগানো, স্যালাইন চলছে। এ দুই শিশু একে অপরের প্রতিবেশী। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের ঠাঁইও হয়েছে একই হাসপাতালের একই বিছানায়।
গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অষ্টম তলার শিশু ওয়ার্ডে হেলাল ও আয়াতকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখা যায়। সাত দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয় আয়াত আর হেলাল ভর্তি হয় তিন দিন আগে। আলাদা শয্যা না পাওয়ায় আয়াতের সঙ্গেই হেলালকে থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছে। দুই শিশুর বাসা রাজধানীর স্বামীবাগে।
পরিস্থিতি যেহেতু অবনতির দিকে যাচ্ছে, তাই সরকারি ছুটির দিনেও মশকনিধন কার্যক্রম যাতে চালু থাকে, সেই পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।অধ্যাপক কবিরুল বাশার, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়লেও ডেঙ্গুর বাহক মশা কমছে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারতে ব্যাপক তোড়জোড় দেখালেও মাঠপর্যায়ে কাজ কতটা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে কোথাও সিটি করপোরেশনের কর্মীদের মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি। যদিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশকনিধনকর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে। অথচ গতকাল ছুটি কাটিয়েছেন ৮৮০ জন মশকনিধনকর্মীর সবাই।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলেছেন, এই মুহূর্তে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানো জরুরি। এক দিনের জন্যও এই কার্যক্রম বন্ধ রাখা উচিত নয়।
ডেঙ্গুতে গতকালও একজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৬৫ জনে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ১৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু।
মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে শিশু ৭৬
স্বামীবাগের বাসিন্দা হেলাল ও আয়াতের স্বজনেরা দাবি করেন, তাঁদের বাসা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকে সব সময়। তবে বাসার কাছে রেলগেটসংলগ্ন এলাকায় কোনো কিছুর নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে ময়লা ও পানি জমে থাকায় মশার জন্ম হচ্ছে। সেখান থেকেই এই দুই শিশু আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে।
হেলাল ও আয়াতের মতো ৭৬ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশুদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। শিশু ওয়ার্ড নামে পরিচিত এই ওয়ার্ডের অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে এখন ডেঙ্গু ‘কর্নার’ (ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত স্থান)। এর পাশেই ডায়রিয়া ও জেনারেল কর্নার। সেখানে গতকাল সকালে ভর্তি করা হয় এক বছরের সোইয়বাকে। মেঝেতে একটি বিছানা জুটেছে তার। গতকাল বেলা ১১টায় এই প্রতিবেদক যখন সেখানে যান, তখন শিশুটিকে অনবরত কাঁদতে দেখা যায়। স্বজনেরা জানান, জ্বর কমছে না কিছুতেই। বারবার শরীর মুছে দিচ্ছিলেন মা–বাবা। ডেঙ্গু হয়েছে কি না, তা জানার জন্য পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে।
শিশু ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতে বিছানা পেতেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর বিছানায় মশারি না থাকায় অন্য রোগে আক্রান্ত শিশুদের স্বজনেরা এ নিয়ে কিছুটা চিন্তিত।
সাড়ে চার বছরের সামরিন আক্তারকে গত বৃহস্পতিবার রাতে এই ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ঈদের দিনে তার জ্বর হয়। যাত্রাবাড়ীতে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসক দেখানো হয়। স্বজনেরা জানান, ওষুধ খাওয়ানোর পর কিছুটা সুস্থও হয়। খেলাধুলা করত। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জ্বর, বমি ও পেটব্যথা শুরু হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাকে।
মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের বেশির ভাগ যাত্রাবাড়ী, গোড়ান ও বাসাবো এলাকা থেকে এসেছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ডেঙ্গু মোকাবিলায় মশকনিধন কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মাসুম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। তাঁর এলাকায় প্রতিদিনই মশকনিধনের কার্যক্রম চলে বলে দাবি করেন তিনি।
দেশের মধ্যে মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে বেশি। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৩৫৭ জন ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে তিনজন আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছেন। এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে গত ছয় মাসে মারা গেছেন ২৩ জন। এর মধ্যে তিন শিশুও রয়েছে।
মুগদা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এবার ডেঙ্গু রোগীদের নানা রকমের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বেশির ভাগই হাসপাতালে দেরি করে আসছেন। তিনি জানান, হাসপাতালে তৃতীয়, অষ্টম ও দশম তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতালের ১১ তলাও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ১৪০ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যাবে।
ছুটি ঠিকই থাকল
দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় ২০১৯ সালে। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মীরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও মশা মারার জন্য মাঠে ছিলেন।
এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়ে খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য প্রজননস্থলের সংখ্যা সর্বোচ্চ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৯ সালে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ড ছিল ২১টি।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে ৩ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশকনিধনকর্মীদের ছুটি বাতিল করে অফিস আদেশ জারি করে। ওই আদেশে বলা হয়, মশকনিধন কার্যক্রম ও জলাবদ্ধতা নিরসনে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঢাকা উত্তর সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শাখার সব পর্যায়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মরত শ্রমিকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
তবে গতকাল সকালে ঢাকা উত্তর সিটির ২৯, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মশকনিধনকর্মীদের ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের মশকনিধনকর্মীরা রায়েরবাজার কমিউনিটি সেন্টারে অবস্থিত কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে মশার লার্ভা নিধনের ওষুধ ও ছিটানোর যন্ত্র (স্প্রে মেশিন) সংগ্রহ করেন। তবে গতকাল সকালে ওই কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকটি তালাবদ্ধ। ভেতরে কয়েকজন রান্নার জোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত রয়েছেন।
কমিউনিটি সেন্টারের নিরাপত্তা প্রহরী মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মশকনিধন সুপারভাইজার ও মশকনিধনকর্মীদের কেউ কাজে আসেননি। পরে মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় এবং মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট সংলগ্ন ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের মশকনিধন কার্যালয়ে গিয়ে কারও দেখা পাওয়া যায়নি।
ছুটি বাতিলের পরও কেন ওষুধ ছিটানো হয়নি, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ছুটি বাতিলের অর্থ হচ্ছে কর্মীরা সাধারণত যেসব কারণে ছুটি নিয়ে থাকেন, তা বাতিল। ছুটির দিনেও (শুক্রবার) কাজ করলে কর্মক্ষমতা কমে যাবে। এটা তো আন্তর্জাতিক আইনও সমর্থন করে না।
তাহলে ছুটি বাতিলের আদেশ কি লোকদেখানো ছিল, এমন প্রশ্নে মেয়র বলেন, বিষয়টি এমন নয়। নানা কারণে অনেকেই ছুটি চেয়ে থাকেন। ঘোষণার পর এসব ছুটির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতেও গতকাল মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মশক ওষুধ ছিটানোর কাজ বন্ধ থাকে। সপ্তাহে এক দিন কর্মীদের বিশ্রাম করার সুযোগ তাঁরা দিয়ে থাকেন।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেবল মশকনিধনকর্মীদের মাঠে থাকলে চলবে না। এই সংকটে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদেরও মাঠে থাকতে হবে। পরিস্থিতি যেহেতু অবনতির দিকে যাচ্ছে, তাই সরকারি ছুটির দিনেও মশকনিধন কার্যক্রম যাতে চালু থাকে, সেই পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।