ঢাকা নগর পরিবহনের বাসে মুখরক্ষার উদ্যোগও বন্ধের পথে

অনেক কথার পর চালু হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই একটি পথে বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা নগর পরিবহনের বাসসেবা। কমেছে বাসের সংখ্যাও।

ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় এখন শুধু বিআরটিসির বাস চলে। ২৩ জানুয়ারি, কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরেছবি: প্রথম আলো

যত্রতত্র বাস থামবে না, টিকিট ছাড়া কেউ উঠবে না, নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকেই যাত্রী ওঠাতে হবে—এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই বছর আগে চালু করা হয়েছিল ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, প্রতিশ্রুতির কিছুই আর মানা হচ্ছে না। সড়কের যেকোনো জায়গায় যাত্রীর হাতের ইশারাতেই থামে বাস। ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চালু করা মুখরক্ষার এই উদ্যোগও এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

দুই ধাপে মোট ১৫০ বাস দিয়ে চালু হয়েছিল ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা। এখন বাস চলছে মাত্র ৩০টি, তা-ও শুধু সরকারি সংস্থা বিআরটিসির। বেসরকারি কোম্পানিগুলো শুরুতে সরকারের এই উদ্যোগে থাকতে আগ্রহ দেখালেও পরে তারা সরে গেছে। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা নগর পরিবহনের প্রথম বাসসেবা চালু হয়েছিল। পরে আরও দুটি রুটে (চলাচলের সুনির্দিষ্ট পথ) এই সেবা চালু হয়েছিল। এখন একটি রুটে আর বাস চলছে না, বাকি দুটিও বন্ধ হওয়ার পথে।

যে তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা চালু হয়, সেসব রুটে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির অন্তত ৪০০টি বাস চলে বলে বিআরটিসির চালকেরা জানান। ফলে যেসব বেসরকারি কোম্পানি ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হয়েছিল, তারা লাভ করতে পারেনি।

ঢাকার ভেতরে চলাচল করা সব পরিবহন কোম্পানিকে একই ‘ছাতার নিচে’ আনার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করে। এর দেড় মাস আগে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দেশকাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠনের তিন বছর পর ঢাকা নগর পরিবহনসেবা চালু হয়, ধীরে ধীরে যার ব্যাপ্তি আরও প্রসারিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা।

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির প্রতিশ্রুতি ছিল, ঢাকা নগর পরিবহনের বাস চালুর পর অন্য কোনো কোম্পানির বাস ওই রুটে চলতে পারবে না। কিন্তু যে তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা চালু হয়, সেসব রুটে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির অন্তত ৪০০টি বাস চলে বলে বিআরটিসির চালকেরা জানান। ফলে যেসব বেসরকারি কোম্পানি ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হয়েছিল, তারা লাভ করতে পারেনি।

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্বে থাকা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীনের দাবি, সময় লাগলেও ঢাকা নগর পরিবহন জনপ্রিয় হবে। সব রুটেই এই পরিবহনের বাস চলবে। এখন যেসব রুটে এই বাস চলে, সেসব রুটে যাতে অন্য কোম্পানির বাস চলতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন

তবে একটি রুটে ইতিমধ্যে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে শুনেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান সাবিহা পারভীন।

ঢাকা নগর পরিবহনের বাস যত্রতত্র যাত্রী তোলে—এমন প্রশ্নের উত্তরেও তিনি দায় চাপিয়েছেন নাগরিকদের ওপর। তাঁর কথা, বেশির ভাগই ঘরের সামনে থেকে বাসে উঠতে চান। নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।

যেভাবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’

ঢাকা ও এর আশপাশে ২০০-এর বেশি রুটে বাস চলাচল করে। যাত্রী তোলার জন্য একই রুটে চলাচল করা এক বাস অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লায় লিপ্ত হয়, যা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ অবস্থার অবসানে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা ‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ’ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীন। মালিকেরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র থাকার সময় আনিসুল হক প্রথম এই উদ্যোগ নেন। পরে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির দায়িত্ব পান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি আড়াই বছরে ১১টি সভা করেছিলেন। কিন্তু কোনো বাস রাস্তায় নামাতে পারেননি।

বেশির ভাগই ঘরের সামনে থেকে বাসে উঠতে চান। নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন

এরপর ঢাকা দক্ষিণের নতুন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। তিনি ছাড়া কমিটিতে আরও রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, গণপরিবহনবিশেষজ্ঞ এস এম সালেহ উদ্দিন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক।

আরও পড়ুন

মেয়র তাপস দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস নামানো হয়। তবে তদারকি না থাকা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে চালু করার দুই বছরের মধ্যেই এই সেবা এখন বন্ধ হওয়ার পথে। যদিও ঢাকা নগর পরিবহন উদ্বোধনের সময় এই সেবা ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় চালুর প্রতিশ্রুতি দেন মেয়র তাপস। কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ হয়নি; বরং এই বাসসেবা এখন বন্ধ হওয়ার পথে। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামও নগর পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, যানজটও কমবে—এমন স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঢাকা শহর থেকে লক্কড়ঝক্বড় বাস সরেনি। বন্ধ হয়নি যাত্রী নিতে বাসে বাসে রেষারেষিও।

মেয়র তাপস দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস নামানো হয়। তবে তদারকি না থাকা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে চালু করার দুই বছরের মধ্যেই এই সেবা এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

কোনোরকমে চলছে

দুই বছর আগে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে নামানো ৫০টি বাসের মধ্যে বিআরটিসির বাস ছিল ৩০টি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্স সিলভার বাস ছিল ২০টি। তবে চালু হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ট্রান্স সিলভার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই রুটে চলা বিআরটিসির বাসের তিনজন চালকের সঙ্গে ২৩ জানুয়ারি কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে এখন বিআরটিসির ১৪-১৫টি বাস চলছে।

বাস না চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মো. ওহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এই রুটে আর বাস চালাতে চান না। অন্য রুটে যেতে চান। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে। এসব নিয়ে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করবেন।

অন্যদিকে ঘাটারচর থেকে পোস্তগোলার কদমতলী পর্যন্ত রুটে এখন বিআরটিসির ১৪-১৫টি বাস চলে। তিনজন চালক প্রথম আলোকে বলেন, চালু থাকা দুটি রুটে বিআরটিসির ৬৪টি বাস ছিল। এখন ৩০টির মতো চলছে। যাত্রী কম থাকায় লোকসান হচ্ছে। আর বাসের সংখ্যাও শুরু থেকেই কম ছিল। যে কারণে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

২২ জানুয়ারি দুপুরে মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ঢাকা নগর পরিবহনের কাউন্টারের সামনে কথা হয় যাত্রী দিদার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর দেখা যায় একটি বাস আসে। যদিও প্রথম দিকে ঢাকা নগর পরিবহন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল; কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হলো না।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম দফায় ৫০টি বাস চালুর পর ২০২২ সালের অক্টোবরে আরও দুটি রুটে ৫০টি করে ১০০ বাস নামানো হয়। এই দুই রুটের মধ্যে একটি ঘাটারচর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত। অন্যটি ঘাটারচর থেকে পোস্তগোলার কদমতলী পর্যন্ত। এর মধ্যে ঘাটারচর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত রুটে হানিফ পরিবহনের ৩০টি বাস ও বিআরটিসির ২০টি বাস চালু ছিল। চার মাস ধরে এই রুটে হানিফ পরিবহনের বাসগুলো চলাচল করছে না। বিআরটিসির বাস চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে ঘাটারচর থেকে পোস্তগোলার কদমতলী পর্যন্ত রুটে এখন বিআরটিসির ১৪-১৫টি বাস চলে। তিনজন চালক প্রথম আলোকে বলেন, চালু থাকা দুটি রুটে বিআরটিসির ৬৪টি বাস ছিল। এখন ৩০টির মতো চলছে।

অঙ্গীকারে ঘাটতি

ঢাকা নগর পরিবহন ভালোভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে—এমন রাজনৈতিক অঙ্গীকারে ঘাটতি আছে বলে মনে করেন যোগাযোগবিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় মেট্রোরেল চালুর পর এর নিচের সড়ককে ভুলে গেলে চলবে না। কারণ, নিচের সড়ক ৮০ ভাগ মানুষ ব্যবহার করে।

ঢাকা নগর পরিবহন চালুর ক্ষেত্রে বাসমালিকদের সিন্ডিকেটকে বড় বাধা বলে মনে করেন বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তাঁর মতে, এই সিন্ডিকেট ভাঙাটাই ঢাকা নগর পরিবহন সফল করার ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ, এখানে অনেকের স্বার্থ-টাকাপয়সা জড়িত। সরকার এত বড় বড় কাজ করতে পারে আর ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারবে না, এটি হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সেটি চায় কি না।