লালন–দর্শন মানুষকে অসাম্প্রদায়িক হতে শেখায়

চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘দ্রোহে প্রতিরোধে লালন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারাছবি: চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সৌজন্যে

বাউল সাধক লালন ফকিরের গভীর তত্ত্বজ্ঞানের উৎস হচ্ছে সমাজের ব্রাত্যজনের চলমান আন্তস্রোতের ভাবসম্পদ। ভারতবর্ষের নবজাগরণ যাদের হাত ধরে শুরু হয়েছে, তারা ইউরোপের রেনেসাঁর সৃষ্টিকর্মের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু লালনের সম্পদ ছিল ব্রাত্যজনের ভাব। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘দ্রোহে প্রতিরোধে লালন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উঠে আসে এসব কথা।

বাউল সাধক লালন ফকিরের ১৩৫তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আয়োজিত হয় এ অনুষ্ঠান।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি নিখিল দাস। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের সঞ্চলনায় প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লাল্টুসহ অন্যরা।

বক্তারা বলেন, লালনের গভীর তত্ত্বজ্ঞানের উৎস কী? সেটি হলো সমাজের ব্রাত্যজনের চলমান আন্তস্রোতের ভাবসম্পদ। বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফিবাদী চিন্তা ও বৈষ্ণব মতের যে মিথস্ক্রিয়ায় বাউল চিন্তা গড়ে ওঠে তা সমাজদেহে একটি শক্তিশালী মতাদর্শ নির্মাণ করে। লালন এটি ধারণ করেছিলেন। তিনি বাউল চিন্তার আলোকে জাত-পাত, ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান গেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন লোক দার্শনিক।

আলোচকেরা বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ২০২৪ গণ–অভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-শ্রমিক-জনতার জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাজার, মন্দির, পীরের দরগাহ, লালনের আখড়া, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে।’

বক্তারা বলেন, এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হুমকিতে নতজানু হয়ে সরকার পাঠ্যপুস্তক সংশোধিত ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করেছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে নারী লাঞ্ছনা, মব ট্রায়ালের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত।

আলোচকেরা বলেন, ’১৯৭২–এর সংবিধান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা–বোনের সম্ভ্রম হারানো জমিন থেকে উঠে আসা। এটি জনযুদ্ধের সংবিধান, মুজিবীয় সংবিধান নয়। সুতরাং যাঁরা ’৭২–এর সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কথা বলেন, তাঁরা হয়তো অজ্ঞতাবশত বা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে বলেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এটি জনগণের কাম্য নয়।’

সভার আলোচকেরা লালন–দর্শনের আলোকে শোষণ-বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের সংগ্রামে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আলোচনা সভা শেষে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা পরিবেশন করেন লালনসংগীত।