বৃহস্পতিবার বিকেল। মাত্র শেষ হয়েছে আসরের নামাজ। মোনাজাত শেষেই বেড়ে যায় একদল স্বেচ্ছাসেবীর ব্যস্ততা। মোটামুটি সবাই ব্যবসায়ী। তবে বেচাবিক্রি নয়, মুসল্লিদের জন্য ইফতারি প্রস্তুত করতেই তাঁদের এই ব্যস্ততা। ততক্ষণে মুসল্লিদের অনেকেই গোল হয়ে, আবার কেউ লম্বা লাইনে বসে গেছেন। অপেক্ষা ইফতারের। এ চিত্র রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি মুসল্লি একসঙ্গে ইফতার করেন। বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও পবিত্র রমজান মাসজুড়ে জাতীয় মসজিদে আয়োজন করা হয় ইফতারের। কে নেই এখানে? ধনী-গরিব, শিক্ষার্থী থেকে চাকরিজীবী, রিকশাচালক, ব্যবসায়ী, ছিন্নমূল মানুষসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ শামিল হন এই ইফতারে।
ইফতারের জন্য অপেক্ষারত কেউ কেউ জিকির করছিলেন, কেউ দরুদ পাঠ করছিলেন। একটু পর মসজিদের মোয়াজ্জিন এসে মাইক হাতে নিয়ে শোনালেন রমজানের ফজিলত।
দোয়াদরুদ পাঠ করার পর ইফতারের আগমুহূর্তে মোনাজাত করে সবার জন্য দোয়া চাইলেন। ইসলাম ধর্মমতে, এই সময়টা দোয়া কবুলের সময়। তাই তো সামনে খাবার রেখে পেটে ক্ষুধা নিয়ে সবাই হাত তুলে দোয়া চাইলেন মহান আল্লাহ তাআলার কাছে।
শুধু মসজিদের ভেতরের অংশ নয়, বাইরের সিঁড়ির অংশেও অনেকে গোল হয়ে বসেন ইফতারি নিয়ে। মুসল্লিদের বাইরে বসে থাকা ভিক্ষুকেরাও বঞ্চিত হননি এই ইফতার আয়োজন থেকে। তাঁদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ইফতারি।
বায়তুল মোকাররমে বন্ধুদের নিয়ে প্রথমবারের মতো ইফতার করতে এসেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাসিম শাহারিয়ার। তিনি বললেন, ‘এর আগে এখানে নামাজ পড়তে এসেছি। আজ এলাম ইফতার করতে ও মাগরিবের নামাজ পড়তে। এত মানুষ একসঙ্গে ইফতার করবে—এটা দেখতেই ভালো লাগছে। কে বড়লোক, কে গরিব—এখানে কেউ জানতে চায় না। রমজান মাস সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।’
২০২০ সালের আগেও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ইফতারের আয়োজন করত ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কিন্তু করোনা মহামারির পর থেকে এই দায়িত্ব এখন নিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতিদিন দুই হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সংগঠন নিজ উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করে থাকে। এই আয়োজনে থাকে খেজুর, শরবত, মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, কলা ইত্যাদি।
এখানে ইফতার আয়োজনের বড় একটি অংশের সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মুসল্লি কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, পবিত্র রমজানে প্রতিদিন ২ হাজার করে মোট ৬০ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন সংখ্যা বাড়ছে। সামনে হয়তো এ আয়োজন আরও বড় হবে।
ঝালকাঠি থেকে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা এসেছিলেন জহিরুল ইসলাম। কোথায় ইফতার করবেন তা ভাবছিলেন। তখনই শুনলেন জাতীয় মসজিদে সবার জন্যই ইফতারের বড় আয়োজন রয়েছে। শুনেই চলে এলেন বায়তুল মোকাররমে। এত মানুষ একসঙ্গে ইফতার করে, তা দেখে অবাকই হয়েছিলেন বলে জানালেন।
ইফতার আয়োজন কমিটির আরেক সমন্বয়ক ইকবাল উদ্দিন বলেন, ‘এখানে ইফতারের জন্য অনেক মানুষ আশা করে আসেন। আমরা কাউকে ফেরাই না। আমাদের যা আছে, তাই সবাই ভাগ করে ইফতার করি। এত মানুষের ইফতারের ব্যবস্থা করতে পারার ব্যাপারটা আনন্দের।’
শুধু পুরুষের জন্য নয়, নারীদের জন্যও রয়েছে ইফতারের আয়োজন। মসজিদের দোতলায় নারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে শতাধিক নারী একসঙ্গে ইফতার করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসিম শাহারিয়ার বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসের শিক্ষা হলো সারা বছর মিলেমিশে থাকার প্রেরণা নেওয়া। রমজান শেষেও যেন কথাটি আমরা স্মরণে রাখি এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নিয়ে চলতে পারি।’