ঢাকা দক্ষিণ সিটি: ‘হস্তক্ষেপে’ সড়ক সংস্কারে দেরি

অক্টোবরের মধ্যে দক্ষিণ সিটির সব সড়ক সংস্কার–মেরামতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

সড়কে খানাখন্দ। উত্তর যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

অক্টোবর মাসের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব সড়কের খানাখন্দ ও গর্ত ভরাটের কাজ শেষ করার কথা ছিল। গত ১৩ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ শাখা থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি কাগুজে দলিল হিসেবেই থেকে গেছে। নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরেরও দুই সপ্তাহ পার হতে চলেছে। প্রয়োজনীয় মেরামত না করায় বেশির ভাগ সড়কের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় ১ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বর্ষায় ২১৪ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় ২৩১ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর মধ্যে গত বর্ষায় ২৭ কিলোমিটার ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে সড়ক সংস্কার ও মেরামতের উদ্যোগ নেয় প্রকৌশল বিভাগ। সিদ্ধান্ত হয়, অক্টোবরের মধ্যে ভাঙচোরা সব সড়ক ঠিক করা হবে। নভেম্বরেই এর সুফল পাবেন নগরবাসী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সিটি করপোরেশনের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়িত হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংখ্যা অনেক বেশি, যে কারণে সময় লাগছে। এর মধ্যে কিছু সড়ক মেরামতের কাজ হয়েছে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগে তিনজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের দুরবস্থা ঠিক করতে তাঁরা অনেক আগেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগসহ দরপত্র প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তাঁরা কাজ শুরু করতে পারেননি। আগের সব ঠিকাদার ছিলেন আওয়ামী লীগের। গণ–অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ওই ঠিকাদারদের সিটি করপোরেশনে আর আসছেন না।

প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ঠিকাদার খুঁজতে হচ্ছে। সড়ক সংস্কারের কাজ পেতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা পরিচয়ে অনেকে করপোরেশনে আসছেন। তাঁদের অনেকে নিয়ম ভেঙে ঠিকাদারি কাজ পেতে চাপ দিচ্ছেন। যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগের এ ধরনের ঠিকাদারি কাজের অভিজ্ঞতা নেই। দেখা যাচ্ছে, কোনো এলাকার একটি সড়কের সংস্কারকাজ পেতে চাইছেন ১০–১২ জন। এসব কারণে সড়ক সংস্কারের পুরো প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। তবে কিছু সড়কের সংস্কার কাজ হয়েছে।

অবশ্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ পেতে দলের নেতা–কর্মীদের চাপের বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন। সেবামূলক কাজ যাতে ঠিকমতো হয়, এই কাজে হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। বিএনপির পরিচয় দিয়ে কেউ চাপ প্রয়োগ করে থাকলে এবং বিষয়টি সিটি করপোরেশন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে তাঁরা দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেবেন।

বিএনপি নেতা তানভীর বলেন, তাঁদের এলাকা শ্যামপুর–কদমতলীর রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। দক্ষিণ সিটির উচিত রাস্তা সংস্কারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।

কোথাও গর্ত, কোথাও পিচ উঠে গেছে

গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকা কাকরাইল, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া ও খিলগাঁও এলাকার ১৮ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। প্রায় প্রতিটি সড়কের কোথাও পিচঢালাই উঠে গেছে, কোথাও বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সঙ্গে ধুলার যন্ত্রণা তো রয়েছেই।

এর মধ্যে বেশি খারাপ অবস্থা দয়াগঞ্জ মোড় থেকে ধোলাইখাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের বেশির ভাগ জায়গায় পিচঢালাই উঠে বড়-ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি সড়কে প্রচুর ধুলা উড়ছে। এই সড়কের যাত্রাবাড়ীর খালপাড় এলাকায় গতকাল বিকেলে কথা হয় দুজন রিকশাচালকের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে আবদুল কাদের নামের একজন চালক বললেন, যাত্রাবাড়ী এলাকার সব রাস্তাই খারাপ।

ইত্তেফাক মোড়েও সড়কের পিচঢালাই উঠে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইত্তেফাক মোড় পেরিয়ে দয়াগঞ্জ থেকে জুরাইন রেলগেটের দিকে যাওয়ার সড়কের অবস্থাও বেহাল। একই অবস্থা জুরাইনের পাশের মীরহাজীরবাগের মাদ্রাসা সড়কের। এই সড়কের জায়গায় জায়গায় গর্ত।

সায়দাবাদ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে যাওয়া পথে উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কেও ছোট–বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে আছে। সায়দাবাদের পাশে গোলাপবাগ মাঠের দক্ষিণ দিকের সড়কের অবস্থাও বেহাল। আবার গোলাপবাগ মোড় থেকে মুদগা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত দুই দশমিক তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের মাঝবরাবর অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়ে আছে। মানুষের ভোগান্তি কমাতে এই সড়কের টিটিপাড়া অংশে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনের কিছু অংশ ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এই পথে চলাচল করা রাইদা পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, খিলগাঁও এলাকার রাস্তা বেশি খারাপ। ভাঙাচোড়া সড়কে চলার কারণে কিছুদিন পরপর গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়।

দক্ষিণ সিটির খিলগাঁও উড়ালসড়কেও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় পিচ উঠে গেছে। মতিঝিলের পাশে গোপীবাগ এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়কের সংস্কারকাজ শেষ না করে ফেলা রাখা হয়েছে। এতে ওই পথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে আছে। কমিউনিটি সেন্টারের পাশের চা–দোকানি হামিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় এই সড়কে গাড়ি চলতে পারছে না। কাজে ধীরগতির কারণে মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রায় সাত বছর আগে নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর সড়কের অবস্থাও ভালো নয়। এর মধ্যে নতুন ওয়ার্ড ৬৮ নম্বরের আওতাধীন ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্টাফ কোয়ার্টার থেকে সারুলিয়া বাজার যাওয়ার সড়কটির অবস্থা খুবই খারাপ। এই সড়কের বেশির ভাগ অংশে খানাখন্দে ভরা।

ওয়ার্ডে কাউন্সিলর না থাকায় অলিগলির সড়কের প্রকৃত চিত্র সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে না বলে মনে করেন লালবাগ এলাকার বাসিন্দা তসলিম হোসেন। তিনি বলেন, লালবাগ-আজিমপুরের মূল সড়কের অবস্থা ভালো। তবে অলিগলির রাস্তার অবস্থা খারাপ।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এখন চলছে অস্থায়ী প্রশাসক দিয়ে। দক্ষিণ সিটিতে ওয়ার্ড আছে ৭৫টি, উত্তর সিটিতে ওয়ার্ড আছে ৫৪টি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথমে মেয়র এবং পরে কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের অনেক নাগরিক সেবা বিলম্বিত হচ্ছে।

নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক মেরামতের বিষয়টি সিটি করপোরেশের নিয়মিত কাজের অংশ। বিভিন্ন এলাকায় সড়কের বেহালের কারণে মানুষ বিরক্ত–ক্ষুব্ধ। সড়ক সংস্কারের বিষয়টি সব সময় সিটি করপোরেশনের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। এই কাজে সময়ক্ষেপণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।