ঢাকায় ভবনে বিস্ফোরণ
সক্ষমতায় ঘাটতি, আছে উদ্ধারকাজে সমন্বয়হীনতা
ফায়ার সার্ভিসকে বিধ্বস্ত ভবনের নকশা দিতে পারেনি রাজউক। ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
ভয়াবহ বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের সাততলা ভবনের বেজমেন্টে পৌঁছাতেই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের সময় লেগেছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা। কেন এত সময় লাগল, এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে শুরু থেকে উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতি ছিল। আবার উদ্ধার তৎপরতার দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিসকে বিধ্বস্ত ভবনের নকশা সরবরাহ করতে পারেনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
অন্যদিকে বিধ্বস্ত ভবনে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর আগে ঝুঁকি নিরূপণের জন্য যে ধরনের কারিগরি এবং প্রকৌশলগত জ্ঞান ও দক্ষতা দরকার, সেই সক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের নেই। কাজটি রাজউকের সহায়তা নিয়ে করতে হয় তাদের। ভবন বিধ্বস্ত বা ধসের মতো ঘটনা ঘটলে ঝুঁকি নিরূপণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কোনো প্রকৌশল শাখা নেই।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ভবন বিধ্বস্ত হওয়ার পর কাঠামোগত প্রকৌশল সহায়তা এবং ভবনের নকশা সরবরাহ করতে রাজউককে অনুরোধ করা হয়। রাজউকের প্রকৌশলী এলেও ভবনের নকশা সরবরাহ করতে পারেননি তাঁরা। অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের কোনো ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কখনোই রাজউক নকশা সরবরাহ করতে পারে না। আর সিদ্দিকবাজারের বিধ্বস্ত ভবনটি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকার কারণে উদ্ধার অভিযানের শুরুতেই বেজমেন্টে যাওয়া নিরাপদ ছিল না। ভবনটি যেন ধসে না পড়ে, সে জন্য শোরিংয়ের (ঠেক দেওয়ার) প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই প্রযুক্তি ফায়ার সার্ভিসের থাকলেও প্রকৌশলী নেই। আবার রাজউককে অনুরোধ করার পরও তাৎক্ষণিকভাবে শোরিং করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতি ছিল।
অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগে রাজউক তাৎক্ষণিকভাবে ভবনের নকশা দিতে পারে না। আবার সিটি করপোরেশনকেও উদ্ধার অভিযানের সময় সেভাবে পাওয়া যায় না।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিদ্দিকবাজারের মতো ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিস নেতৃত্ব দিলেও সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো সংস্থার সহায়তা তারা চাইতে পারে। এ ধরনের ঘটনায় প্রকৌশলগত সহায়তার দায়িত্ব রাজউকের। আর বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজটি সিটি করপোরেশনের। কিন্তু কোনো সংস্থাই ফায়ার সার্ভিসকে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেয় না।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৫৬ থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভবনের নকশাগুলো রাজউকের কাছে ‘ম্যানুয়ালি আর্কাইভ’ (কাগজের নথি সংক্ষণ) করা আছে। যে কারণে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের নকশা তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিস অবশ্য নকশা ওইভাবে চায়নি। ভবনটির নকশা শনিবারের মধ্যে পাওয়া যাবে। পুরোনো ভবনের নকশা সহজে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে রাজউকের উচ্চপর্যায়ের একটি দল শনিবার (আজ) সভায় বসবে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের মে মাসের পর থেকে রাজউক এলাকায় নতুন যেসব ভবন হয়েছে, সেগুলোর নকশা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
শুধু নকশা নয়, উদ্ধার তৎপরতায় রাজউকের প্রকৌশলগত সহায়তা নিয়েও ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মকর্তা অসন্তুষ্টির কথা বলেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল শুক্রবার বিকেলে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর স্টিলের পাইপ এনে ভবনটির ধস ঠেকানোর কাজ শুরু করে রাজউক। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের ‘আর্কাইভ সিস্টেম’ ভালো নয়। ঢাকার ৪০ থেকে ৫০ বছরের পুরোনো ভবনের নকশা নেই তাদের কাছে। রাজউক সব মালিকের কাছ থেকে ভবনের কাঠামোগত নকশা, ফায়ার ও ইলেকট্রিক্যাল নকশা চাইতে পারে। এতে করে সব নকশা রাজউকের হাতে চলে আসবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রতি পাঁচ বছর পরপর এটা করে থাকে। রাজউক এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে।
গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) বিকেলে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত একটি সাততলা ভবনের বেজমেন্ট থেকে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২৩ জন নিহত হয়েছেন।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিত্যক্ত লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিধ্বস্ত ভবনে উদ্ধার তৎপরতায় কেমন যন্ত্রপাতি দরকার
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন বিধ্বস্ত হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা তাদের রয়েছে। ২২ তলা উঁচু ভবনে কাজ করার মতো ক্রেনও এখন তাদের রয়েছে। তবে রানা প্লাজার মতো বড় দুর্যোগ হলে এককভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা তাদের নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। সিদ্দিকবাজারের উদ্ধার অভিযানে কারিগরি সহায়তা নিতে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এখন অনেক ভারী যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু কাঠামোগত প্রকৌশল দক্ষতা তাদের নেই।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক পর্যায়ের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, ভবনের কোনো অংশ ধসে পড়লে অন্য অংশের কাঠামো ধরে রাখতে শোরিং করা হয়। এটি পাইপের মাধ্যমে করা যায়, বড় বড় কাঠের খাম্বা দিয়ে করা যায়, রড দিয়ে করা যায়, হাইড্রোলিক জ্যাক দিয়েও করা যায়। ১০০ টন ওজন নিতে পারে, এমন হাইড্রোলিক জ্যাক (ভার বহন ও ঠেক দেওয়ার যন্ত্র) আছে ফায়ার সার্ভিসের কাছে। যদি এর চেয়েও বেশি ওজন হয়, তখন বিশেষ ধরনের ক্রেন লাগে।। এটি ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই, তবে অন্য বাহিনীর কাছে আছে। এমনকি কয়েকটি বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও এই ক্রেন আছে। বড় বড় সরকারি প্রকল্প, যেমন ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে ৫০০ টনের বেশি ওজন নিতে পারে, এমন ক্রেন আছে। ফায়ার সার্ভিস অবশ্য চাইলে তাদের সহায়তা নিতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো পর্যাপ্ত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি এখনো ফায়ার সার্ভিসের নেই। তবে বহুতল এক বা একাধিক ভবন ধসে পড়ার মতো ঘটনা ঘটলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর মতো সব ধরনের সক্ষমতা এখন তাদের আছে।
ভবনধস ঠেকাতে কাজ চলছে
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি যাতে ধসে না পড়ে, সে জন্য রাজউক ভবনের নিচতলার ক্ষতিগ্রস্ত কলামে স্টিলের পাইপ দিয়ে অস্থায়ী সাপোর্ট (দাঁড় করিয়ে রাখার ব্যবস্থা) দেওয়ার কাজ করছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত স্টিলের মোট ৯টি পাইপ বসানো হয়েছে। নিচতলার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ওই পাইপগুলো বসানো হয়েছে। প্রতিটি পাইপের ব্যাস ৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ২০ ফুট। পাইপ বসানোর সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতের মধ্যেই আরও তিনটি পাইপ বসিয়ে কলামগুলোতে সাপোর্ট দেওয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশনস) অবসরপ্রাপ্ত মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগে রাজউক তাৎক্ষণিকভাবে ভবনের নকশা দিতে পারে না। আবার সিটি করপোরেশনকেও উদ্ধার অভিযানের সময় সেভাবে পাওয়া যায় না। এতে রেসকিউ প্ল্যান বা উদ্ধার পরিকল্পনা করতে দেরি হয়, যা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।