২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গুলশানে ভবনে আগুন: সতর্কসংকেত আমলে নেওয়া হয়নি

আগুন নেভাতে চেষ্টার কমতি রাখেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
ছবি: সাজিদ হোসেন

গুলশানের বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কসংকেত (অ্যালার্ম) বেজে উঠেছিল। কিন্তু ভবনে থাকা বেশির ভাগ পরিবার প্রথমে সেটি আমলে নেয়নি। অন্যদিকে যাঁরা ‘অ্যালার্ম’ শুনে ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বের হয়েছেন, তাঁরাও জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার করেননি। এ ছাড়া নিষেধ করার পরও কেউ কেউ আতঙ্কে ভবনের ওপরের দিকের তলাগুলো থেকে ঝাঁপ দেন। এসব কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের ১৪ তলা ওই ভবনের গতকাল রোববার রাতের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আর যে দুজন মারা গেছেন, তাঁদের কেউই অগ্নিদগ্ধ হননি। দুজনই ভবনের ১২ তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে মারা গেছেন।

মারা যাওয়া দুজন হলেন আনোয়ার হোসেন (৩০) ও মো. রাজু (৩৫)। এর মধ্যে আনোয়ারকে গত রাতে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আর রাজু রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁরা দুজনই ভবনের ১২ তলার একটি ফ্ল্যাটে কাজ করতেন। রাজু ছিলেন বাবুর্চি, আনোয়ার গৃহকর্মী ছিলেন।

ওই ফ্ল্যাটের মালিক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ফাহিম সিনহা। তাঁর স্ত্রী সামা রহমান সিনহা আগুন লাগার সময় লিফটে আটকা পড়েছিলেন। পরে সপ্তম তলায় লিফট থেকে কোনো রকমে বের হয়ে বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে নিচের সুইমিংপুলে পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। এতে মাথা, হাত, পা–সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি আগুনে দগ্ধ হন। তাঁকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।

আগুনে আহত এক নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
ছবি: সাজিদ হোসেন

সামা রহমানসহ মোট চারজনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের দুজন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, সামা রহমানকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

বহুতল এই ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন মাহফুজুল হাসান। আজ ওই ভবনের ঘুরে দেখার পর তিনি বলেন, আগুনে ভবনের ১০ তলার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজেছে। সেটা শুনে যাঁরা নিচের তলার দিকে ছিলেন, তাঁরা নেমেছেন। আগুন লাগার পরে প্রত্যেকেই যদি জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ব্যবহার করতেন, তাহলে সবাই নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারতেন। কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছে, ওই সময় যাঁরা ভবনে ছিলেন, তাঁরা মনে করেছিলেন ‘ফলস অ্যালার্ম’ হয়েছে। যে কারণে তাঁরা বিষয়টি পাত্তা দেননি।
আগুন লাগার পর নিরাপত্তার কারণে ভবনটির বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আজ দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে আসবাব সিরিয়ে নিচ্ছেন ভবনে থাকা পরিবারগুলো। সেখানে কথা হয় ভবনের পঞ্চমতলার একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ভবনে গ্যাস–বিদ্যুৎ না থাকায় আপাতত অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় থাকবেন। যে কারণে কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কিছু আসবাব সরিয়ে নিচ্ছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরা ফিরে আসবেন।

ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী রায়হান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ফায়ার সার্ভিস পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ভবনটি তাঁদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ফোনে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মালিকদের বিষয়টি অবহিত করেছেন। ভবনে বসাবাস করতে কোনো ঝুঁকি নেই বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা তাঁদের জানিয়েছেন।

ভবন থেকে উদ্ধার করে আনা হচ্ছে এক শিশুকে
ছবি: সাজিদ হোসেন

নিয়মের ব্যত্যয় খুঁজে পায়নি রাজউক

গুলশানের এই ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অঞ্চল-৪–এর অধীন। অঞ্চল-৪–এর পরিচালক এ কে এম মকসুদুল আরেফীন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বিধি মোতাবেক ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে নিয়মের ব্যত্যয় খুঁজে পায়নি রাজউক।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ফরিদা হোসেন গং নামে একজনের নামে ২০২০ সালে ভবনটির পুনর্নির্মাণ–সংক্রান্ত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এই অনুমোদন অনুযায়ী ভবনটির দুটি বেজমেন্টসহ ১৪ তলার নির্মাণ অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। আর ওই বছরের শেষের দিকে ভবনমালিকের পক্ষ থেকে বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেটও নেওয়া হয়। সাধারণত ভবনের সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ প্রচলিত বিধিবিধান মেনে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করলেই বসবাস সনদ সরবরাহ করে রাজউক।

ভবনটিতে জরুরি নির্গমন পথসহ অগ্নিনিরাপত্তায় প্রচলিত সব ব্যবস্থাই ছিল। এরপরও অগ্নিকাণ্ডের হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছে।

ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না

ভবনের সপ্তমতলার একটি ফ্ল্যাট থেকেই রোববার রাতে আগুনের সূত্রপাত বলে মোটামুটি নিশ্চিত ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। আজ সকালে ভবনটি পরিদর্শনের পর ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, সপ্তমতলার ফ্ল্যাটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত।
তবে বিকেলে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী  সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কারণ, প্রতিটি জিনিসই পাশাপাশি অবস্থানে রয়েছে। গ্যাসের পয়েন্ট আছে যেখানে, তার পাশেই বিদ্যুতের পয়েন্টও রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রচুর দাহ্যবস্তু রয়েছে সেখানে। কোনটা থেকে আগুনটা শুরু হয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে না।’

আগুনের তাপ আর ধোঁয়া থেকে বাঁচতে অনেকেই আশ্রয় নেন বারান্দায়। রোববার রাতে ঢাকার গুলশানে
ছবি: সাজিদ হোসেন

ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটিরও প্রধান তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। ভবন নির্মাণের সময় শুধু একটি এনওসি (অনাপত্তিপত্র) নিয়েছিল। ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে সাজসজ্জায় প্রচুর পরিমাণে দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকাল ইন্টেরিয়রের (সাজসজ্জা) কাজ করতে ডিজাইনাররা দাহ্য বস্তু ব্যবহার করেন। তারা যে প্লাইউড বা বোর্ড ব্যবহার করছেন—এগুলো সবই দাহ্য পদার্থ। এ রকম দাহ্য পদার্থ প্রতিটি ভবনেই পাবেন। সুতরাং বলা যায় না যে এটাই আগুনের উৎস।’

এর আগে আজ দুপুরে ভবন পরিদর্শনে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ভবনটি সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। এত সুন্দর ভবন, অথচ আগুন লাগল। জরুরি পরিস্থিতির জন্য ফায়ার ড্রিল করার মতো গার্ড ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিলেন কি না, তা জানা নেই। সাধারণত থাকে না।