ডিএনসিসিতে ৩৬ পদচারী-সেতুর মধ্যে কাজ শেষ মাত্র ৪টির

এখন প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পদচারী সেতুর পিলারছবি: প্রথম আলো।

রাজধানীর প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুসংলগ্ন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পদচারী–সেতুর নির্মাণকাজ গত বছরের জুনে উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল ছয় মাসের মধ্যে সেতুটি চালু করার। কিন্তু এক বছরের বেশি কেটে গেছে, সেতুটি চালু হয়নি।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের এ পদচারী–সেতু ছাড়াও ‘ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক নিরাপত্তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আরও ৩৫টি পদচারী–সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রকল্পের ছয়টি প্যাকেজের আওতায় সেতুগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই।

গত রোববার (৩০ জুন) পর্যন্ত এই ৩৬ সেতুর মধ্যে মাত্র ৪টির শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুগুলো ব্যবহার করে পথচারীরা রাস্তা পারাপার হচ্ছে। এ ছাড়া একটি সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই নিজেদের টাকায় নির্মাণ করেছে সংস্থাটি। আর তিনটি সেতুর মূল কাঠামো (কলাম ও বিম) বসেছে। ১৮টি সেতু এখনো তৈরি করা যায়নি। এসব সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি বলতে শুধু ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) স্থাপন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৯৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় পদচারী–সেতু নির্মাণ বাবদ। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আর ছয় মাস।

এদিকে প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার পর নানান জটিলতা ও বাধার মুখে ১০টি সেতুর নির্মাণ থেকে সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিন

গত মঙ্গলবার দুপুরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পদচারী–সেতুর নির্ধারিত স্থানে লোহার খুঁটি (কলাম) বসানো হয়েছে। শিক্ষার্থীসহ পথচারীরা ওই অংশে রাস্তা পার হচ্ছে চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, একটি পদচারী–সেতু নির্মাণে সাধারণত ছয় মাস সময়ই যথেষ্ট। মেয়র সেই হিসাব করেই শিক্ষার্থীদের কাছে ওই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী সেতুটি চালু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর কিংবা চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সেতুটির নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েও কোনো ফল পায়নি সিটি কর্তৃপক্ষ। অবশেষে গত ২১ মার্চ ঠিকাদার মেসার্স এস এম কনস্ট্রাকশনের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। আর সেতুটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিএনসিসির আরেক ঠিকাদার মাইশা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেডকে।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পদচারী সেতুর পিলারের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন পথচারীরা
ছবি: প্রথম আলো।

নতুন ঠিকাদার মাইশা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ পারভেজ প্রথম আলোকে জানান, নকশা অনুযায়ী সেতুর কাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। জুলাইয়ের (চলতি মাস) দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাঁরা নির্ধারিত স্থানে সেতুর কাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু করবেন। আগস্টের মাঝামাঝি সেতুটি দিয়ে মানুষ রাস্তা পারাপার করতে পারবে।

প্রতিশ্রুতির বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওই সেতু নির্মাণে গাফিলতির কারণে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেতুটি আগামী অক্টোবরের মধ্যে চালু করে দেওয়া হবে।’

এদিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়াসহ মোট ১৫টি পদচারী–সেতুর স্থানে যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে শ্যামলী ও বছিলা সড়কের পদচারী–সেতু দিয়ে পথচারীদের পারাপার হতে দেখা গেছে। বাকি ১৩টি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে শুধু একটিতে সেতুর কলাম বসানো হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ হয়েছে ভিত্তি স্থাপন পর্যন্ত।

কাজ শেষ মাত্র চারটির

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছিল চার বছর আগে, ২০২০ সালে। সিটি করপোরেশন দরপত্র প্রক্রিয়ায় যায় এর দুই বছর পর, ২০২২ সালের আগস্টে। এরপর আরও প্রায় দুই বছর (জুন-২৪ পর্যন্ত) পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সিটি করপোরেশন শেষ করেছে মাত্র চারটি পদচারী–সেতুর কাজ।

সেতুগুলো হলো উত্তরায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের রাজলক্ষ্মী বাসস্ট্যান্ড ও রাজউক কলেজসংলগ্ন সেতু এবং শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড ও বছিলা সড়কের বাঁশবাড়ী এলাকার পদচারী–সেতু। এর বাইরে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ, আদাবর ও কুড়িল চৌরাস্তাসংলগ্ন সেতুর মূল কাঠামো তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

এদিকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্পের ডব্লিউডি-৪ প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এম কনস্ট্রাকশনের কার্যাদেশ বাতিল করেছে ডিএনসিসি। ওই প্যাকেজের আওতায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাতটি পদচারী–সেতু নির্মাণের কথা ছিল। যদিও গাছ কাটতে হবে, তাই সেখান থেকে তিনটি সেতুর নির্মাণ বাদ দেওয়া হয়। বাকি চারটির মধ্যে তিনটির ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে, একটির কলাম বসেছে।

অসমাপ্ত অবস্থায় মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পদচারী সেতু
ছবি: প্রথম আলো।

ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করার বিষয়ে উত্তর সিটির ওই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চুক্তি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ, বাস্তবায়নে অবহেলা, সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়া, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করাসহ সিটি করপোরেশনের সুনাম ক্ষুণ্ন করায় কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের ডব্লিউডি-৫ প্যাকেজের আওতায় মিরপুর এলাকায় চারটি পদচারী–সেতু নির্মাণের কথা ছিল। কাজটি পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এস এম রহমান ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু সড়ক বিভাজকের গাছ কাটার কারণে ওই প্রতিষ্ঠানকে গত বছরের জুনে কালোতালিকাভুক্ত করে করপোরেশন। এরপর ওই চার সেতুর নির্মাণকাজ থেমে গেছে।

সিটি করপোরেশন জানায়, কালোতালিকাভুক্ত হওয়া ও কার্যাদেশ বাতিল হওয়া ঠিকাদারদের অবশিষ্ট কাজের জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দ্রুত কার্যাদেশ দেওয়া হবে।

প্রকল্প থেকে বাদ ১০টি সেতু

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অমত, নির্ধারিত জায়গায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বাধা, গাছ কাটার প্রয়োজন পড়াসহ নানা বাধা ও জটিলতায় ১০টি পদচারী–সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ।

সেতুগুলো হলো উত্তরা গাউছুল আজম অ্যাভিনিউতে মাস্টারমাইন্ড স্কুল, উত্তরা গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ে লুবানা হাসপাতাল, মিরপুর সিরামিক রোডের বঙ্গবন্ধু কলেজ, বিমানবন্দর সড়কের নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ও আর্মি স্টেডিয়াম, গুলশান-১–এর ভোলা মসজিদ ও শুটিং ক্লাব, গুলশান-২–এর আজাদ মসজিদ, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এবং সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সেতু।

উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ও আর্মি স্টেডিয়ামের সামনে দুটি পদচারী–সেতু নির্মাণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মত নেই। তাই বাদ দেওয়া হয়েছে। গুলশানের তিনটি ও মোহাম্মদপুরের দুটি নির্মাণ করতে গেলে সড়কের পাশে ও বিভাজকের গাছ কাটতে হবে। কিন্তু গাছ যেহেতু কাটা যাবে না, তাই সেতুই বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি তিনটির জায়গা নিয়ে কিছু জটিলতা থাকায় বাদ দিতে হয়েছে।

মিরপুরের শিয়ালবাড়ি সড়কে পদচারী সেতুর ভিত্তি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো।

পথচারীদের দুর্ভোগ

পদচারী–সেতুর কাজ শেষ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে পথচারীদের রাস্তা পারাপারে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তারা ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এতে সড়কে যানজটও হচ্ছে। এ ছাড়া ফুটপাতের জায়গায় ভিত্তি করে কাজ ফেলে রাখায় পথচারীদের স্বাভাবিক চলাচলেও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতার।

রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান হোসেন বলেন, চার মাস আগে কলাম বসানো হয়েছিল। এরপর নির্মাণকাজ থমকে আছে। পদচারী–সেতু নাকি আর হবে না, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে। ওই অংশে প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থীকে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয় বলেও জানান তিনি।

শ্যামলীর আদাবরে বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে পদচারী সেতুর অবস্থা
ছবি: প্রথম আলো

সার্বিক অগ্রগতি ২০ ভাগ

কার্যাদেশ পাওয়ার পরও পদচারী–সেতুর নির্মাণকাজে বিলম্ব হওয়ার বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সেতুর নির্ধারিত জায়গা ও নকশা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তারসহ অন্যান্য সেবার সংযোগ সরানো এবং মাটি পরীক্ষার ফল দিতে দেরি করেছে সিটি করপোরেশন। যে কারণে সেতুর কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।

প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ ফরহাদ প্রথম আলোকে জানান, ‘প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ২০ ভাগ। কিছু জায়গায় যৎসামান্য কাজ হয়েছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদেরও কাজ দ্রুত শেষ করতে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।’ সেতুগুলোর নির্মাণকাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে বলেও জানান তিনি।