এখন না হয় বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়েছে দেশের প্রান্ত অবধি। ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা, এমনকি শীতাতপযন্ত্রও সাধারণ দৃশ্যে পরিণত; কিন্তু এককালে গরমে হাতপাখাই ছিল গা জুড়ানোর একমাত্র উপায়। সেই ‘পাখা হাতে রমণী’র ছবি দেশের আধুনিক চারুকলায় এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছিল শিল্পী কাজী আবদুল বাসেতের হাতে। ইদানীং তাঁর ছবির প্রদর্শনী বিশেষ দেখা যায় না। দর্শকদের জন্য এবার সেই বিখ্যাত ‘পাখা হাতে রমণী’র ছবিসহ কাজী আবদুল বাসেতের বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রকলার সম্ভার দেখার সুযোগ তৈরি করল বেঙ্গল গ্যালারি।
গতকাল শুক্রবার ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হলো ‘বৃষ্টিতে রোদের কণা’ নামে শিল্পী কাজী আবদুল বাসেতের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। এতে অ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, চারকোল, জল রং, কালিকলমের রেখাচিত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ৭২টি শিল্পকর্ম রয়েছে। সব কটি শিল্পকর্মই বিভিন্ন শিল্পানুরাগীর ব্যক্তিগত সংগ্রহের। বিশেষত নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জন্য তাঁরা তাঁদের সংগৃহীত শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন। প্রদর্শনী চলবে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত। রোববার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী রফিকুন নবী। কাজী আবদুল বাসেত ছিলেন তাঁর শিক্ষক ও দীর্ঘদিনের সহকর্মী। তিনি বলেন, তাঁর (আবদুল বাসেত) ছবি এখন পাওয়াই যায় না। সেখানে একত্রে এতগুলো কাজ দেখতে পাওয়া খুবই দুর্লভ। ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব সহজ–সরল নিভৃতচারী জীবনযাপন করতেন। পায়জামা ও ধূসর রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। ছাত্রদের কাজ শেখাতেন হাতে ধরে। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি শিকাগোয় ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। রফিকুন নবী বলেন, বহু বছর পরে ২০০৭ সালের দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে সেখানে প্রাক্তন ছাত্রদের কাজের মধ্যে কাজী আবদুল বাসেতের বেশ কিছু শিল্পকর্ম দেখতে পেয়েছেন। ওই কাজগুলোর শিল্পমানের জন্যই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন ধরে সংরক্ষণ করেছে, দেখে তিনি বেশ বিস্মিত ও একই সঙ্গে গর্বিতও হয়েছিলেন।
আবদুল বাসেতের কাজ সম্পর্কে রফিকুন নবী বলেন, তিনি মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ধারাতেই কাজ করেছেন। গ্রামীণ নারী ও গৃহস্থালি জীবন তিনি তাঁর নিজস্ব শিল্পভাষায় উপস্থাপন করে আধুনিক চিত্রকলায় ভিন্নমাত্রা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে তাঁর পাখা হাতে রমণীর ছবিগুলো ছিল ‘ট্রেডমার্কের’ মতো।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক শিল্পী সৈয়দ আবুল বার্ক্ আলভী বলেন, আবদুল বাসেতের সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার গভীর সখ্য ছিল। তাঁদের দুজনের কাজের মধ্যেও বেশ সাদৃশ্য লক্ষণীয়। অনেক সময় মনে হয়, তারা একে অন্যকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
বিশেষ অতিথি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, কাজী আবদুল বাসেত ১৯৫৬ সালে আর্ট কলেজ থেকে পাস করে নবাবপুর হাইস্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া ও শিল্পী মুর্তজা বশীরও এই স্কুলে তাঁর (মতিউর রহমান) শিক্ষক ছিলেন। কাজী আবদুল বাসেত পাকিস্তান আমলেই একজন প্রধান শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, আবু তাহের, আবদুর রউফের মতো শিল্পীরা তাঁর সহপাঠী ছিলেন। জীবনে প্রথম দিকে তিনি বাস্তবধর্মী কাজ করেছেন। গ্রামীণ জীবন, বিশেষ করে নারী, শিশু, নিসর্গ এসব ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ফেরার পর মধ্যম পর্যায়ে তিনি বিমূর্ত ও আধা বিমূর্ত রীতির কাজ করেন। শেষ জীবনে আবার বাস্তব রীতির কাজের ধারায় ফিরে এসেছিলেন। এখন তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী হচ্ছে। এটি আয়োজন করে বেঙ্গল গ্যালারি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।
এই প্রদর্শনীতে দর্শকেরা বিখ্যাত সেই ‘পাখা হাতে রমণী’ শীর্ষক কয়েকটি কাজ দেখতে পাবেন। এ ছাড়া বিছানায় অর্ধশায়িত নারী, মা ও মেয়ে, কলসি কাঁখে নারী, পাখি হাতে নারী, মাথায় ঝাঁকা ভরা মাছ নিয়ে মাছ বিক্রেতা, বিশেষ ভঙ্গিতে সাদা শাড়ি পরে বসে থাকা নারী, শিশু কোলে মা, এমন অনেক চেনা দৃশ্যের পাশাপাশি আছে তাঁর বিমূর্ত রীতির বেশ কয়েকটি কাজ। সেখানে রং রেখা ও আকারের নান্দনিক বিন্যাসে শিল্পসুষমা উদ্ভাসিত করে তুলেছেন তিনি।
জীবদ্দশায় কাজী আবদুল বাসেতের মাত্র দুটি একক প্রদর্শনী হয়েছে। তবে বহু যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁর জন্ম ৪ ডিসেম্বর। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ, যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ—এখান থেকে তিনি স্নাতক সমমানের ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরে নবাবপুর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপরে যোগ দেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে (চারুকলা অনুষদ), এখানে ৩০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্রজীবনেই কাজী আবদুল বাসেত তার নান্দনিক বোধ ও সৃজন প্রতিভায় বিদগ্ধজনের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি নিখিল পাকিস্তান চারুকলা প্রদর্শনীতে দ্বিতীয় পুরস্কার পান। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে অতীশ দীপংকর স্বর্ণপদক, ১৯৯৮ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা ও ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর জীবনাবসান ঘটে ২৩ মে ২০০২। কাজী আবদুল বাসেত দেশের নিসর্গ ও মানুষ প্রধানত নারীর মর্মবেদনাকে মায়াময় বিষণ্নতায় তাঁর কাজে উপস্থাপন করেছিলেন। প্রদর্শনীতে এলে সেই ছবিগুলো এখনো গভীরভাবে স্পর্শ করে যাবে দর্শকদের হৃদয়।