অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ তৈরি করতেন

(বাঁ থেকে) অধ্যাপক রেহমান সোবহান, লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক রওনক জাহান ও লেখক মফিদুল হক। রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে, ২৯ নভেম্বর ২০২৪ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর শিক্ষার্থী ও আশপাশের মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ, চিন্তার প্রসার ও মেধা–মনন চর্চার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলতেন। তাঁর অবদান খুবই মূল্যবান। কিন্তু বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হলেও তিনি তেমন একটা লেখেননি। তাঁর বেশি কিছু না লেখাটা জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে।

শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ছিল অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন আয়োজন করেছিল দুই দিনের অনুষ্ঠান। শুক্রবার সমাপনী অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়েছিল রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে।

বুধবার প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। সেখানে ‘সভ্যতার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গুণীজন বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।

শুক্রবার ছুটির দিনের সন্ধ্যায় আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র, সহকর্মী ও গুণমুগ্ধরা সমবেত হয়ে তাঁকে স্মরণ করেন অনুরাগ ও শ্রদ্ধায়। সংগীত, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী ও স্মৃতিচারণা দিয়ে সাজানো ছিল অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বেঙ্গল পরম্পরা সংগীত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধ্রুপদি সংগীত পরিবেশনা দিয়ে। এরপর অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এটি নির্মাণ করছেন পিপুল খান। এর পরে শুরু হয় আলোচনা পর্ব।

আরও পড়ুন

আলোচকেরা জ্ঞানসাধক অকৃতদার মানুষটির সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচারণাতেই মূলত আলোচনা কেন্দ্রীভূত রেখেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, শিক্ষক হিসেবে তাঁর পাঠদানের ধরন, সরল সাদামাটা জীবনযাপন, পছন্দ, প্রিয় বিষয়াদিও উঠে এসেছে। তবে বিচিত্র বিষয়ে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েও তাঁর নিজে তেমন কিছু না লেখা নিয়ে সবার সবার কণ্ঠে আক্ষেপ ছিল। সবারই একই কথা, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের রচনার স্বল্পতা জাতির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়েছে।

আলোচনার সূচনা করেছিলেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের সভাপতি, তাঁর ছাত্রী ও পরে সহকর্মী অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি শিক্ষক হিসেবে অব্দুর রাজ্জাকের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘২৫ বছর হলো তিনি চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর স্মৃতি এখনো সজীব রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে তিনি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। ব্যক্তিগতভাবে সারা জীবন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সহায়তা পেয়েছি।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

অধ্যাপক রাজ্জাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো তাঁর অফিস কক্ষের দরজা বন্ধ রাখতেন না জানিয়ে রওনক জাহান বলেন, যে কেউ তাঁর কাছে সব সময় যেতে পারত। যেকোনো প্রশ্ন করতে পারত। তবে তিনি কোনো প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতেন না। বরং নিজেই আরও অনেকগুলো সম্পূরক প্রশ্ন করতেন। তাতে বেশ কিছু গভীর ইঙ্গিত থাকত, সূত্র পাওয়া যেত। প্রাসঙ্গিক অনেকগুলো বইয়ের রেফারেন্স দিতেন। এভাবেই তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার আগ্রহ তৈরি করতে এবং শিক্ষার্থীদের নিজে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি আগ্রহী করে তুলতেন।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে অতিথিরা। রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে, ২৯ নভেম্বর ২০২৪
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে নিজের বিভিন্ন সময়ের কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন লেখক-গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেন, তিনি এত বড়মাপের একজন জ্ঞানী মানুষ হয়েও অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। পোশাক পরেছেন খুব সাধারণ, কথা বলেছেন ঢাকার স্থানীয় ভাষায়। সবাই তাঁর কাছে অবারিত স্নেহ-প্রীতি পেয়েছে। বাড়িতে তাঁর কাছে সব সময় প্রচুর মানুষ যেত। সেই সময়ে বড় বড় রাজনীতিবিদ, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, মুদিখানার দোকানদার, শিশু-কিশোরসহ সবাইকে নিয়ে তিনি একসঙ্গে বসতেন। গভীর আন্তরিকতা নিয়ে সবার সঙ্গে তাঁর সেই বিশেষ বাচনভঙ্গিতে কথা বলতেন। দিলখোলা হাসি হাসতেন। প্রিয়জনদের নিজে রেঁধে খাওয়াতে, কাঁচাবাজার করতে, দাবা খেলতে খুব পছন্দ করতেন।

আরও পড়ুন


একবার রাজশাহীর সাহেববাজারে অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে কেনাকাটা করতে যাওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘অধ্যাপক রাজ্জাক বেশ কিছু মাছ কিনেছিলেন। কিন্তু দাম দিতে গিয়ে কেন যেন বিলম্ব করছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, স্যার, মাছের দামটা দিতে হয়। তিনি মলিন হেসে বললেন, “পকেটমার আমার পকেট ফাঁকা করে দিয়েছে।’”

এভাবে অনেক টুকরা টুকরা ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে একটা সময় বদরুদ্দীন উমরের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে। কথা থামিয়ে তিনি মঞ্চ ত্যাগ করেন।

প্রাবন্ধিক ও লেখক মফিদুল হক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। বক্তৃতায় তিনি বলেন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর চিন্তার মৌলিকতা ও গভীরতা। ইতিহাসকে তিনি সেই মৌলিক চিন্তার আলোয় বিশ্লেষণ করতে পারতেন। তিনি লিখিত আকারে ‘বাংলাদেশ: স্টেট অব দ্য নেশন’ শীর্ষক যে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ স্মারক–বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটি এত গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত যে তা বাংলাদের বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনাতেও খুবই প্রাসঙ্গিক।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের জ্ঞান বিতরণের সঙ্গে প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিসের সাদৃশ্য রয়েছে। সক্রেটিসের মতো তিনিও তাঁর শিক্ষার্থী ও আশপাশের মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ, চিন্তার প্রসার ও মেধা-মননের চর্চা অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর অবদান খুবই মূল্যবান। নতুন প্রজন্ম যেন তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে, সে জন্য অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। শেষ হয় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেতারবাদন পরিবেশনা দিয়ে।