রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় ২০১৯ সালের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দুটি চিতা কিনে আনা হয়েছিল। সে সময় এই খবর ঘটা করে প্রচার করেছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। দুটির মধ্যে একটি চিতা আড়াই বছর আগে মারা যায়। কিন্তু এই খবর আর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। অন্যদিকে, বেঁচে থাকা চিতাটির জন্য এত দিনেও সঙ্গীর ব্যবস্থা করা হয়নি।
জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো প্রাণীর মৃত্যুর খবর তারা স্বেচ্ছায় গণমাধ্যমকে জানায় না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, জবাবদিহি-স্বচ্ছতার স্বার্থে প্রাণীর মৃত্যুর খবর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দুটি চিতা কিনে আনা হয়। এর একটি নারী, অন্যটি পুরুষ।
চিতা দুটির মাধ্যমে বংশবিস্তার ঘটানো যাবে বলে প্রত্যাশা ছিল জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের। তবে তার আগেই ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল নারী চিতাটি মারা যায়। জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, চিতাটি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
জাতীয় চিড়িয়াখানার বর্তমান পরিচালক মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার। তিনি এখানে পরিচালক হয়ে আসার আগেই চিতাটি মারা যায়।
রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রাণী মারা গেলে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় কাউকে জানায় না। তবে কেউ জানতে চাইলে তিনি লুকোছাপা করেন না।
জাতীয় চিড়িয়াখানার উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যপদে থাকার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিতাটি মারা যাওয়ার তথ্য এত দিন জানতেন না।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বেই চিতার গুরুত্ব রয়েছে। যেকোনো কারণেই চিতা মারা যেতে পারে। কিন্তু কোনো প্রাণী মারা গেলে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের উচিত তা জনগণকে জানানো। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে বলতে হবে যে এই দিন প্রাণীটি মারা গেছে। তারা চেষ্টা করেও প্রাণীটিকে বাঁচাতে পারেনি। তারা দুঃখ প্রকাশ করছে।
আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এমন হলেই ভালো হতো। তবে যেহেতু আইনগত বা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেই, তাই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ব্রিফিং করে না। কিন্তু চিড়িয়াখানা জনগণের অর্থে পরিচালিত হয়। তাই জনগণকে তথ্য জানানো উচিত। এতে জবাবদিহি-স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। চিড়িয়াখানার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ে।’
চিতা কেনার পরিকল্পনা
সঙ্গী মারা যাওয়ার পর থেকে জাতীয় চিড়িয়াখানায় পুরুষ চিতাটি একাকী অবস্থায় রয়েছে। জাতীয় চিড়িয়াখানার তথ্যমতে, পুরুষ চিতাটির নাম পলাশ। তার জন্ম ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল।
জাতীয় চিড়িয়াখানার যে খাঁচায় এই চিতাটিকে রাখা হয়েছে, তার দুটি অংশ। একটি অংশ ইটের দেয়াল দেওয়া ছোট ঘর। বৃষ্টিবাদল হলে সেখানে অবস্থান নিতে পারে চিতাটি। অবশ্য সেখানে থাকলে দর্শনার্থীরা চিতাটিকে দেখতে পান না।
খাঁচার আরেকটি অংশ নেট দিয়ে বেড়া দেওয়া। এই অংশে ফাঁকা জায়গা, ঘাস ও গাছ রয়েছে। সেখানে এলে চিতাটিকে দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন।
গত শনিবার দুপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় চিতার খাঁচার সামনে গিয়ে এক ঘণ্টা অবস্থান করেও পলাশের দেখা পাননি এই প্রতিবেদক। কারণ, চিতাটি এই সময়ে দেয়াল দেওয়া ছোট ঘর থেকে বের হয়নি।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসেছিলেন তারেক আজিজ নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় চিতা থাকার পরও তা দেখতে না পেলে একটু খারাপ তো লাগেই।’
জাতীয় চিড়িয়াখানায় একই সময় আগত অন্য দর্শনার্থীরাও চিতা দেখতে না পেয়ে হতাশ হন। কোনো কোনো দর্শনার্থী সন্দেহ প্রকাশ করেন, ছোট ঘরটির দরজায় ছিটকিনি থাকায় চিতাটি হয়তো আটকে আছে।
অবশ্য এ বিষয়ে গত শনিবার জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলে, চিতাটিকে আটকে রাখা হয়নি। চিতাটি নিজে থেকেই ছোট ঘরটিতে অবস্থান করছে। চিতাটি সুস্থ আছে বলেও দাবি করে তারা।
পুরুষ চিতাটির নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) কোনো প্রাণী কেনা যায়নি। যারা প্রাণী সরবরাহ করে, তারা এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় তা কেনা যায়নি। তবে চলতি অর্থবছরে প্রাণী কেনার চেষ্টা থাকবে। প্রাণী কেনার তালিকায় চিতা আছে। এবার দুই থেকে তিনটি চিতা কেনার চেষ্টা থাকবে।
দেশি প্রাণী উপস্থাপনের তাগিদ
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, চিতা ও চিতাবাঘ এক নয়। দেশে একসময় অনেক চিতাবাঘ ছিল। এখনো পার্বত্য অঞ্চলে কিছু চিতাবাঘ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে দেশে কখনো চিতা ছিল না। ভারতে একসময় চিতা ছিল। এখন দেশটিতে চিতার বংশবিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ইউরোপ ও আফ্রিকায় চিতা পাওয়া যায়।
চিতা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির প্রাণী। চিতার দেহ সরু। মাথা ছোট ও গোলাকৃতির হয়ে থাকে। চিতার বৈজ্ঞানিক নাম ‘Acinonyx Jubatus’। আবদ্ধ অবস্থায় চিতার আয়ুষ্কাল ১৫ থেকে ২০ বছর।
চিতা সাধারণত খরগোশ, বন্য ছাগল প্রভৃতি শিকার করে খায়। মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা চিতাটিকে সপ্তাহে পাঁচ দিন ৩ থেকে ৫ কেজি হাড়সহ গরুর মাংস, এক দিন জীবন্ত প্রাণী খেতে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো প্রাণী বিদেশ থেকে আনার আগে তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। একই সঙ্গে দেখতে হবে, প্রাণীটি পালনের সক্ষমতা কর্তৃপক্ষের আছে কি না।
দেশের মানুষ এখনো দেশি প্রাণী ঠিকভাবে চেনে না বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে বিড়ালের আটটি প্রজাতি রয়েছে। আট প্রজাতির বাঘ আছে। এগুলো দেশের চিড়িয়াখানায় ভালোভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। বিদেশ থেকে প্রাণী কিনে আনার আগে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের উচিত দেশের প্রাণীগুলোকে সুন্দরভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা।