গভীর নলকূপে শুধু মিটার, রাজস্ব হারাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা
ব্যক্তিগত এসব গভীর নলকূপ থেকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
রাজধানীর দক্ষিণখানের মোল্লারটেক এলাকায় নিজ বাড়িতে গত বছর গভীর নলকূপ বসিয়েছেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপের বৈধ গ্রাহকদের প্রতিবছর নবায়ন ফি, অনুমোদন ফি, সারচার্জ ও ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু তাঁকে এসব ফি দিতে হয় না। শুধু প্রতি মাসে পানির বিল দিলেই চলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোল্লারটেকের এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াসার পুরোনো লাইন ছিল। তাতে পানি আসত না। তাই একটা ডিপ টিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) বসাই। এখানকার ওয়াসার লোককে এ জন্য এক লাখ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি মিটার লাগিয়ে দিয়েছেন, আর কোনো ফি দিতে হবে না বলেও জানিয়েছেন।’
মোল্লারটেকের এই গ্রাহকের পানির বিলের হিসাব থেকে জানা যায়, বছরে পানির জন্য তাঁর গড় খরচ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি বৈধ অনুমোদন নিলে প্রতিবছর নবায়ন ফিসহ অন্যান্য ফি দিতে হতো প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তাতে বিলসহ বছরে গড়ে খরচ ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। এর বাইরে বৈধ সংযোগ পেতে তাঁকে এককালীন দেওয়া লাগত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
রাজধানীর বসুন্ধরা, ভাটারা, নন্দীপাড়া, ঢাকা উদ্যান, দক্ষিণখান, কাফরুল ও বাউনিয়া এলাকায় শুধু মিটার লাগানো গভীর নলকূপের সংখ্যা বেশি।
ঢাকা ওয়াসার অনুমোদিত ব্যক্তিগত গভীর নলকূপের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, এসব নলকূপের বাইরে মোল্লারটেকের এই গ্রাহকের মতো আরও অন্তত দুই হাজার জনের বাসাবাড়িতে গভীর নলকূপ রয়েছে। অবৈধ নলকূপ থেকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সংস্থাটি। এ টাকার বড় অংশ যাচ্ছে ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে।
প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এভাবে মিটার বসাতে পারেন না। এটা চাকরিবিধিরও পরিপন্থী। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এটা মেনে নিচ্ছে, সেটাও একটা অপরাধ।
ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসা থেকে গভীর নলকূপের অনুমতি নিতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সরকারি ফির বাইরেও অর্থ দিতে হয় দালালকে। আবার নবায়নের জন্য ধার্য ফি অনেকটাই বেড়েছে। ফলে অতিরিক্ত ফি ও জটিলতার কারণে অনেক গ্রাহকই অবৈধভাবে গভীর নলকূপ বসাচ্ছেন। আর তাঁদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোরের মতো কোনো কর্মী গোপনে সংযোগ দিয়ে থাকতে পারে। ধরা পড়লে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অনুমোদনহীন নলকূপ থেকে ওয়াসা রাজস্ববঞ্চিত হয়, এটা অন্যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে পানির কষ্ট থাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে ফেলে। পরে তাদের জরিমানা করে বৈধ করা হয়।’
‘এমন নলকূপ আছে কি না, জানি না’
ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহব্যবস্থা বর্তমানে ১০টি জোন বা অঞ্চলে বিভক্ত। আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প—এ তিন ধরনের গভীর নলকূপ বসানোর অনুমতি দেয় সংস্থাটি। কোনো গ্রাহক গভীর নলকূপ বসাতে চাইলে ওয়াসার মডস জোনে (আঞ্চলিক কার্যালয়) আবেদন করেন। আবেদনের প্রাথমিক শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় ওয়াসার লাইন থাকতে হবে। ওয়াসার রাজস্ব শাখা পরীক্ষা করে দেখে, কোনো বিল বকেয়া আছে কি না।
আবেদনকারীর স্থাপনা মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে তা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে কয়েক ধাপ পার হয়ে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য যায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দেন। এই পুরো প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। এরই সুযোগ নিচ্ছেন ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ করে মডস জোনের কর্মীরা।
রাজধানীর বসুন্ধরা, ভাটারা, নন্দীপাড়া, ঢাকা উদ্যান, দক্ষিণখান, কাফরুল ও বাউনিয়া এলাকায় শুধু মিটার লাগানো গভীর নলকূপের সংখ্যা বেশি। ওয়াসার নথি অনুযায়ী, রাজস্ব জোন ৮-এর অন্তর্ভুক্ত বারিধারা, বসুন্ধরা, বাড্ডা, কুড়িল ও ভাটারা এলাকায় ২৫০টির বেশি শুধু মিটার লাগানো গভীর নলকূপ রয়েছে।
এসব গভীর নলকূপের বিষয়ে জানতে এই জোনের উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রধানিয়ার সঙ্গে ৯ নভেম্বর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। বিষয়টি শুনেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘এমন নলকূপ আছে কি না, আমি জানি না। আপনি কীভাবে জানলেন, এমন নলকূপ আছে? আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে কর্তৃপক্ষকে দেন।’
এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য ও বক্তব্য জানতে চেয়ে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন পাঠানো হয়। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এমন নলকূপ আছে কি না, আমি জানি না। আপনি কীভাবে জানলেন, এমন নলকূপ আছে? আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে কর্তৃপক্ষকে দেনজোনের উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রধানিয়া
আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি
গভীর নলকূপের পৌনে এক ইঞ্চি, এক ইঞ্চি ও দেড় ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপে সংযোগ দেওয়া হয়। পাইপের ব্যাসের ভিত্তিতে গ্রাহকদের অনুমোদন ও নবায়ন ফি দিতে হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গভীর নলকূপের বার্ষিক নবায়ন ফি, অনুমোদন ফি, সারচার্জ ও ভ্যাট বাবদ ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। মোট ৪ হাজার ৮২টি বৈধ গভীর নলকূপ থেকে এই রাজস্ব পেয়েছে সংস্থাটি।
প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এভাবে মিটার বসাতে পারেন না। এটা চাকরিবিধিরও পরিপন্থী। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এটা মেনে নিচ্ছে, সেটাও একটা অপরাধ।আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান
ঢাকা ওয়াসা প্রতিটি মিটারের বিপরীতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাসিক বিল করে। এই বিলসংক্রান্ত সফটওয়্যারে ওয়াসার আওতায় কত মিটার রয়েছে, তা সংরক্ষিত থাকে। এই সফটওয়্যার থেকে জানা যায়, কোন গ্রাহক অনুমোদিত ও বৈধ আর কোন গ্রাহকের শুধু মিটার লাগানো রয়েছে।
গবেষণা ও নীতি-বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এভাবে মিটার বসাতে পারেন না। এটা চাকরিবিধিরও পরিপন্থী। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এটা মেনে নিচ্ছে, সেটাও একটা অপরাধ।
আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, গভীর নলকূপ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। একদিকে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধভাবে বসানো নলকূপের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।