ঢাকার দুই সিটি
গাছ-জলাশয়হীন কংক্রিটের শহরে কষ্ট বাড়ছে গরমে
পার্কের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা উন্নয়নের নামে ঢাকা শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কটি চারদিকে টিন দিয়ে ঘেরা। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা, ‘পার্কের উন্নয়নকাজ চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’ ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, পার্কের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গত শনিবার দুপুরে এই প্রতিবেদক পার্ক এলাকায় গিয়ে পার্ক ঘেঁষে বসানো একটি চায়ের দোকানে ত্রিপলের ছাউনির নিচে কয়েকজনকে গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখলেন।
কথা হয় সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কাজের সুবাদে ১৭-১৮ বছর ধরে পান্থকুঞ্জ এলাকায় আসা-যাওয়া করতে হয় তাঁকে। শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পান্থকুঞ্জ পার্কের গাছ কাটার পর এই এলাকায় তাপ বেড়ে গেছে। আগে গরমে পার্কে ঢুকে গাছের ছায়ায় আরাম করা যেত, এখন ঢোকাও যায় না।
রাজধানীর শাহবাগ এলাকার শিশুপার্কে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ফুল ব্যবসায়ী বিপুল মাকসুদ জানালেন, আগে এই শিশুপার্কের ৪০ ভাগের মতো জায়গায় গাছ ছিল। বাকি অংশে নানা ধরনের খেলনা ও ফাঁকা জায়গা ছিল। এখন অনেক গাছই আর নেই।
আর ঢাকার ফার্মগেটের আনোয়ারা উদ্যান নামে থাকলেও বাস্তবে এখন সেটি নেই। সেখানে মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেও বেশ কিছু গাছ ছিল, যা কেটে ফেলা হয়েছে। ফার্মগেট থেকে পান্থকুঞ্জ হয়ে শাহবাগের শিশুপার্ক প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। কয়েক বছরের ব্যবধানে এই তিনটি স্থানের সবুজ গাছগাছালি প্রায় হারিয়ে গেছে।
শুধু পার্ক বা ফাঁকা জায়গা নয়, রাস্তার পাশে ও সড়ক বিভাজকের গাছপালাও কেটে ফেলা হচ্ছে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি সময় রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের সড়ক বিভাজকের অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে তখন।
পার্ক উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা উন্নয়নের নামে ঢাকা শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ঢাকা শহরে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে। অথচ রাজধানী শহরসহ সারা দেশে যে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, ছায়া দেওয়ার মাধ্যমে তা থেকে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই গাছ। গাছের পাশাপাশি জলাধারও গরমের কষ্ট লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত গাছ ও জলাশয় না থাকায় মানুষের কষ্ট এখন চরমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু গাছপালা ও জলাশয়ের মাধ্যমে স্বস্তিতে থাকতে পারে। ঢাকা শহরে এই গাছ ও জলাশয় ধ্বংস করে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনা হয়েছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, তাপমাত্রা ও স্বস্তি ভিন্ন বিষয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও হাতিরঝিলের পাশে বকুলগাছের ছায়ায় বসলে সে রকম গরম অনুভূত হবে না। কারণ হলো গাছের ছায়া ও পানি। তাপের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি থেকে জলীয় বাষ্পের স্তর তৈরি হয়, যা মানুষের শরীরে লাগলে স্বস্তি আসে। ফলে ওই তাপমাত্রা মানুষ অনুভব করে না।
ঢাকায় সবুজ ৮%
বিশ্বের শীর্ষ যেসব জনবহুল শহর রয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। মানুষের বাড়তি চাপের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ও অবকাঠামোর চাপ স্বাভাবিকভাবে গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। এই বাড়তি চাপ সামলাতে পর্যাপ্ত গাছপালা নেই।
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম।
গত এক দশকে ঢাকা শহরে সবুজের পরিমাণ যে ব্যাপকভাবে কমেছে, তা উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায়। ‘ঢাকা শহরের বায়ু, পরিবেশ ও বাসযোগ্যতা’ শিরোনামের সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০০৯ সালে সবুজের আচ্ছাদন ছিল ১২ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার, যা শহরের ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। এক দশক পর ২০১৯ সালে ঢাকা শহরে সবুজের আচ্ছাদন কমে ১২ দশমিক ৩৩ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়।
সবুজের মতো খারাপ অবস্থা জলাশয়েরও। বিআইপির ‘ঢাকা শহরের বায়ু, পরিবেশ ও বাসযোগ্যতা’ গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০০৯ সালে জলাভূমি ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাপ থেকে রক্ষায় কাজ করছেন তাঁরা। ঢাকা উত্তরে খালের পাড়, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকে ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। আরও ২ লাখ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
একটি অঞ্চলের ৪০ ভাগ বনভূমি ও জলাশয় থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরীতে এই পরিমাণ বনভূমির যৎসামান্যই আছে। অন্যদিকে কংক্রিট তাপ ধরে রাখে এবং গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। ঢাকা শহরে একদিকে কংক্রিট বাড়ছে, অন্যদিকে গাছপালা ও জলাভূমি কমছে। এতে মানুষের গরমের কষ্ট বাড়ছে।
অসহ্য গরম থেকে রক্ষায় ছাদবাগান থেকে শুরু করে কোথাও গাছ লাগানোর জায়গা থাকলে ঢাকাবাসীকে তা করতে হবে। সেই সঙ্গে গাছ লাগানো ও জলাশয় উদ্ধারের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।