উত্তরা থেকে আগারগাঁও
মেট্রোরেল পুরোদমে চালুর প্রস্তুতি
যাত্রীরা করছেন শখের ভ্রমণ। কর্তৃপক্ষ ত্রুটি সংশোধন করছে।এ মাস থেকে থামতে পারে পল্লবী স্টেশনে। জনবল নিয়োগ চলছে।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পথে পুরোদমে মেট্রোরেল চালুর প্রস্তুতি চলছে। মিরপুরের পল্লবী স্টেশনে চলতি মাস থেকে মেট্রোরেল থামানোর চিন্তাভাবনা করছে কর্তৃপক্ষ। এরপর মিরপুর ১০ নম্বর স্টেশনে মেট্রোরেল থামতে পারে। মার্চ মাসের শেষের দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সব স্টেশন চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থাটির সূত্র বলছে, মেট্রোরেলের ১০ দিন চলাচল সম্পন্ন হলে মূল্যায়ন বৈঠক করা হবে। মেট্রোরেল চালুর পর কী কী সমস্যা ধরা পড়েছে, সামনে করণীয় কী, নতুন স্টেশনে মেট্রোরেল থামালে চ্যালেঞ্জ কী—এসব বিষয় নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হবে।
মেট্রোরেল চালুর এক সপ্তাহে পেরিয়েছে। গত বুধবার প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অতিথিরা টিকিট কেটে ভ্রমণ করেছেন। বৃহস্পতিবার থেকে সাধারণ যাত্রী নিয়ে চলছে। মঙ্গলবার এক দিন সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে ছয় দিন সাধারণ যাত্রী নিয়ে চলেছে। এর মধ্যে খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর রাতে (থার্টি ফার্স্ট নাইট) ওড়ানো ফানুস মেট্রোরেলের লাইনে এবং ওপরের বিদ্যুতের তার ও খুঁটিতে আটকে যায়। এ কারণে পরদিন মেট্রোরেলের চলাচল দুই ঘণ্টার মতো বন্ধ রাখতে হয়।
মেট্রোরেল বিশেষায়িত, আধুনিক ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট গণপরিবহনব্যবস্থা। যাত্রীর পাশাপাশি ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষকেও অনেক কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হবে, ততই এর চলাচল মসৃণ হবে।সামছুল হক, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ১০ দিন চলার পর তাঁরা একটা মূল্যায়ন বৈঠক করবেন। পরে কোন স্টেশনে থামানো শুরু হবে, তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি দাবি করেন, এখন ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ টিকিট কাটার বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যান্য স্টেশন চালু করতে বেশি দিন লাগবে না। লোকবল নিয়োগের কাজ পুরোদমে চলছে।
যে কারণে সব স্টেশনে থামছে না
ডিএমটিসিএলের ভাষ্য, ঢাকার মানুষকে অভ্যস্ত করার জন্য সব স্টেশনে মেট্রোরেল থামানো হচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, শুধু যাত্রীদের অভ্যস্ততাই মূল কারণ নয়, ডিএমটিসিএলের প্রস্তুতিতেও ঘাটতি আছে। বিশেষ করে সব স্টেশন চালু করে যাত্রী পরিবহন করার মতো দক্ষ জনবল প্রতিষ্ঠানটির নেই। এখন নিজস্ব লোকবলের পাশাপাশি পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
এর বাইরে শেওড়াপাড়া স্টেশনসহ কোথাও কোথাও টুকটাক কাজও বাকি আছে। রাজধানী ঢাকার ঘনবসতি ও গণপরিবহনের অভাব প্রকট। এ অবস্থায় সব স্টেশনে থামা শুরু করলে যাত্রীর চাপ সামলানো কঠিন হবে। এখন বেশির ভাগ যাত্রী একক যাত্রার টিকিট কেটে যাতায়াত করছেন। স্থায়ী কার্ডধারী বেড়ে গেলে হয়তো টিকিট কাটার ঝামেলা কিছুটা কমবে।
এ পর্যন্ত যাত্রী ও আয়
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ প্রথম ছয় দিনের যাত্রী চলাচল ও আয়ের একটা অনুমিত হিসাব পেয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ওই হিসাব অনুসারে, প্রথম ছয় দিনের প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার যাত্রী যাতায়াত করেছেন। গড়ে ৫০টি ট্রেন চলেছে। ব্যবহৃত হয়েছে চার থেকে পাঁচটি ট্রেন। একেকটি ট্রেনে ছয়টি করে কোচ রয়েছে। এ কয়েক দিনে সব মিলিয়ে আয় হয়েছে ৫০ লাখ টাকার কিছু বেশি। এ সময়ের মধ্যে স্থায়ী টিকিট বিক্রি হয়েছে সাড়ে চার হাজারের মতো। বেশির ভাগ যাত্রী যাতায়াত করেছেন একক যাত্রার টিকিট দিয়ে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা মেট্রোরেলের যাত্রী যাতায়াত ও আয়ের হিসাবকে এখন ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইছেন না। তাঁরা বলছেন, এটা যাত্রী নিয়ে অনেকটা পরীক্ষামূলক চলাচল। প্রথমত, মেট্রোরেল সব স্টেশনে থামছে না। ফলে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়ার আগে যে যাত্রী চলাচলের পূর্বাভাস করা হয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়া যাবে না।
মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দুই দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। দিনে পরিবহন করবে ৫ লাখ যাত্রী। তবে এর জন্য প্রতিটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী চলতে পারবে বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এখন সর্বোচ্চ ২০০–এর আশপাশে যাত্রী চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পরপর মেট্রোরেল চলাচলের কথা। এখন চলছে ১০ মিনিট পরপর। মেট্রোরেল ভোর থেকে চালু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলাচল করে থাকে। কিন্তু এখন মাত্র চার ঘণ্টা চলছে।
লোকবলের অভাব
২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়ার পর যেসব লোকবল যুক্ত হয়েছে, এর প্রায় সবই নির্মাণকাজ কিংবা কারিগরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। অধিকাংশ লোকবলই কর্মকর্তা পর্যায়ের, জ্যেষ্ঠ পদের। মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য নতুন লোকবল নিয়োগ দিতে হয়েছে। তাঁদের আবার প্রত্যেকের প্রশিক্ষণের দরকার।
এ পর্যন্ত মেট্রোরেল পরিচালনায় ২৭৪ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেনচালক (অপারেটর) রয়েছেন ২৪ জন ও স্টেশন নিয়ন্ত্রক (স্টেশন কন্ট্রোলার) ৫৮ জন। চালক ও স্টেশন নিয়ন্ত্রক—উভয়ই ট্রেন চালাতে পারবেন। প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি অনেকের। ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, ট্রেন পুরোদমে চালাতে হলে হাজারখানেক জনবল লাগবে। নতুন করে আরও ৪০০ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মেট্রোরেল পরিচালনায় যুক্ত করতে বছরখানেক লেগে যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল আরও ছয় মাস পরে চালু করলে হয়তো লোকবলের সমস্যা এতটা হতো না। তবে এখনকার সময়টা শেখার পর্ব হিসেবে দেখা যায়। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বর্তমানে পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকবল কাজে লাগানো হচ্ছে। অবশ্য তাঁদের সঙ্গে চুক্তিতে সহায়তার শর্ত রয়েছে।
ভুগিয়েছে ভেন্ডিং মেশিন
মেট্রোরেল চালুর পর সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে টিকিট কাটার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভেন্ডিং মেশিন)। গত বৃহস্পতিবার সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে চলাচল শুরুর পরই আগারগাঁও স্টেশনে বসানো ভেন্ডিং মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। পরে তা সারানো হয়। এখনো মাঝেমধ্যে এই যন্ত্র বিকল হয়ে যাচ্ছে।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ভেন্ডিং মেশিনসহ ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মারুবেনি ও ভারতের এলঅ্যান্ডটি কোম্পানি। চুক্তির শর্ত অনুসারে, দুই বছর আগে ভেন্ডিং মেশিনে বাংলাদেশি মুদ্রার তথ্য দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। সে সময় সবচেয়ে ব্যবহৃত নোটগুলোর তথ্য দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ উপলক্ষে অনেক নোটই পরিবর্তন হয়ে গেছে। একেকটা নোটের কয়েকটি সিরিজ বাজারে এসে গেছে। ফলে দুই বছর আগে সফটওয়্যারে থাকা নোটের বাইরে অন্য নোট প্রবেশ করালে ভেন্ডিং মেশিন কাজ করছে না। এখন বাজারে সরবরাহ আছে—এমন সব নোটের তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ভেন্ডিং মেশিনের সমস্যা ৯০ শতাংশ সমাধান হয়ে গেছে। এ ছাড়া তাঁরা ব্যাংক থেকে কিছু নোট এনে রেখে দিয়েছেন। কেউ নিজের নোট দিয়ে টিকিট কাটতে সমস্যা হলে স্বেচ্ছাসেবকেরা সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে কাজ করে এমন নোট দিচ্ছেন।
২০১২ সালে নেওয়া মেট্রোরেল প্রকল্প এক দশক পর আংশিক চালু হয়েছে। চালু হওয়া মেট্রোরেল প্রকল্পটির নাম এমআরটি লাইন-৬। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে ১৭টি স্টেশন থাকছে। মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেলের প্রথম পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয় ২০২১ সালের আগস্টে। ১৬ মাস পর গত ২৮ ডিসেম্বর সাতটি স্টেশনের মধ্যে মেট্রোরেল চালু হয়েছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল বিশেষায়িত, আধুনিক ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট গণপরিবহনব্যবস্থা। যাত্রীর পাশাপাশি ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষকেও অনেক কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হবে, ততই এর চলাচল মসৃণ হবে। তিনি আরও বলেন, অভিজ্ঞতা নেই বলে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হয়েছে।
মেট্রোরেল চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় ডিএমটিসিএল নিজে এই দায়িত্ব না নিয়ে শুরুতে আউটসোর্স করতে পারত। তিনি বলেন, বিদ্যুতের তারে ফানুস পড়ার কারণে দুই ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখার ঘটনা থেকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ আছে। কারণ, পুরোদমে চালুর পর মেট্রোরেল দুই ঘণ্টা বন্ধ রাখলে পুরো শহর অচল হয়ে যাবে। ফলে এখনই অভিজ্ঞ লোক যুক্ত করতে হবে।
‘শখের ভ্রমণ’
দেশের প্রথম মেট্রোরেলে এখনো শখের ভ্রমণ চলছে। যাত্রীদের বেশির ভাগেরই মূল উদ্দেশ্য মেট্রোরেলে চড়তে কেমন, তা দেখা। প্রথম চার দিন যে চাপ ছিল, তা কিছুটা কমে গেছে। এখন আর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে স্টেশনের ফটক পার হতে হচ্ছে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ভিড় আরও কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন কিছুটা ভিড় অব্যাহত থাকতে পারে।
গতকাল মেট্রোরেল দেখতে এসেছিলেন মানিকগঞ্জের দুই বন্ধু মাহফুজুর রহমান ও ওমর ফারুক। তাঁরা আগের দিন মোহাম্মদপুরে আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। গতকাল সকাল নয়টার দিকে আগারগাঁও স্টেশনে এসে খুব বেশি ভিড় পাননি। দ্রুতই এক যাত্রার টিকিট কেটে মেট্রোরেলে চড়েছেন। মাহফুজ বলেন, আসলে ফেসবুকে ছবি দেওয়ার জন্যই এত দূর থেকে আসা।
ব্যাংক কর্মকর্তা আজমল হোসেন বেশ কিছুদিন ধরে পরিকল্পনা করছেন ছোট দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে মেট্রোরেলে চড়বেন। তিনি বলেন, ছেলেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান টেলিভিশনে মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। এরপর থেকেই চড়ার আবদার। আগামী শনিবার সকালে মগবাজারের বাসা থেকে আগারগাঁও যাবেন। সেখান থেকে মেট্রোরেলে চড়বেন। এরপর দিয়াবাড়িতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে আসবেন।