কবি রাজ্জাক দেওয়ানের বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

যে দুই বই প্রকাশ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। ‘মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান: বাউল অঞ্জলী (প্রথম খণ্ড)’ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ‘মাতাল রাজ্জাক: গীতিমালা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে।

মরমি সাধক কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ানের গান নিয়ে প্রকাশিত একটি সংকলন বই নিয়ে শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আলোকায়ন প্রকাশনীর ‘মাতাল রাজ্জাক: গীতিমালা’ বইটিতে বিনা অনুমতিতে এবং কোনো স্বীকৃতি না দিয়ে ‘মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান: বাউল অঞ্জলী (প্রথম খণ্ড)’ বইয়ের সব গান ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রথম বইয়ের দুজন সম্পাদক। এদিকে দ্বিতীয় বইয়ের সম্পাদক তপন বাগচী বলছেন, বইটি নিয়ম মেনে অনুমতি নিয়েই প্রকাশ করা হয়েছে।

রোববার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ‘মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান: বাউল অঞ্জলী (প্রথম খণ্ড)’–এর দুই সম্পাদক ইকবাল জাফর ও মহসীন দেওয়ান লিটন।

কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান। বইয়ের মধ্যে থাকা ছবি।

‘মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান: বাউল অঞ্জলী (প্রথম খণ্ড)’ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ‘মাতাল রাজ্জাক: গীতিমালা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সংবাদ সম্মেলনে দুই সম্পাদক জানান, তাঁরা এই কবিকে নিয়ে স্মরণিকা প্রকাশ করেছেন ২০১৫ সালে। সেখানে ছিল ৫২ টি গানের সংকলন। এর পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁকে নিয়ে বই। সেখানে ছিল কয়েক শ গানের সংকলন। বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের জন্য আরও কিছু গান তাঁরা সংরক্ষণ করেছিলেন। এসব গান নিয়ে বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক তপন বাগচী নিজের সম্পাদনায় বই প্রকাশ করেছেন। সেখানে বইয়ের গান বা তথ্যপ্রাপ্তির কোনো স্বীকারোক্তি নেই।

রোববার দুপুরে রাজধানীর বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন—ক্র্যাবের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দুই সম্পাদক। বাঁয়ে ইকবাল জাফর, ডানে মহসীন দেওয়ান লিটন।

এই বই প্রকাশের পর ২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলা চলাকালে তাঁরা বাংলা একাডেমিকে চিঠি দেওয়ার পর বইটি মেলা থেকে সে বছর তুলে নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে বইয়ের প্রকাশক জামাল নাসের মুকুল প্রথম আলোকে জানান, ২০২২ সালে মেলা কমিটি তাঁকে বইটি তুলে নিতে বললে তিনি মেলা থেকে সেটা তুলে নেন। তবে তিনি কবির দুই ছেলে কাজল দেওয়ান ও সুজন দেওয়ানের অনুমতি নিয়েই বইটি প্রকাশ করেছিলেন বলে জানান। এদিকে অভিযোগকারি ইকবাল জাফর ও মহসীন দেওয়ান বলেন, সুজন দেওয়ান মারা গিয়েছেন ২০১৯ সালে আর তপন বাগচীর বই প্রকাশ হয়েছে ২০২২ সালে। অর্থাৎ অনুমতি নেওয়ার প্রসঙ্গটি মিথ্যাচার।

ইকবাল জাফর ও মহসীন দেওয়ান লিটন রোববারের সংবাদ সম্মেলনে তপন বাগচীর বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বনের অভিযোগ এনে তাঁর বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি করেন। তপন বাগচী এ বছর ফোকলোর বিভাগে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তপন বাগচী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংকলিত বই অনেকেই প্রকাশ করতে পারে। এটা চুরি করা হয় না। তা ছাড়া এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন স্বয়ং কবি রাজ্জাক দেওয়ানের বড় ছেলে কাজল দেওয়ান। আর বাংলা একাডেমি আমাকে একটি মাত্র বইয়ের জন্য পুরস্কার দেয়নি। দিয়েছে ফোকলোর নিয়ে কাজের জন্য সার্বিকভাবে। ফলে এই দাবিটি অবান্তর।’

কুমিল্লার সংগ্রাহক এম এ ছোবহান সংগ্রহ করেছিলেন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত বাউলের প্রাণ রাজ্জাক গীতিমালা বইটি।

এ ব্যাপারে কবিপুত্র কাজল দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবার গানের খাতার পাণ্ডুলিপি আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। ছোট ভাই সুজন দেওয়ান আমার কাছ থেকে নিয়েছিল তপন বাগচীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হবে বলে। পরে দেখলাম ছোট ভাইয়ের বন্ধু ইকবাল জাফর ও মহসীন দেওয়ান লিটনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বিষয়টা ভালো লাগে নাই। ২০২০ সালে প্রকাশিত “মরমী সাধক মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান: বাউল অঞ্জলী (প্রথম খণ্ড)” বইয়ে অনেক ভুল ছিল। আমার বাবার কথা অনেক জায়গায় বদলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি বইটি ভালোভাবে প্রকাশিত হোক, তাই তপন বাগচীকে দিয়েছি।’

তবে ইকবাল জাফর ও মহসীন দেওয়ান লিটন প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা মরমি কবি রাজ্জাক দেওয়ানের বইয়ের পাণ্ডুলিপির একটি অংশ সংগ্রহ করেছেন কুমিল্লার সংগ্রাহক এম এ ছোবহানের কাছ থেকে। এরমধ্যে ছিল ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘বাউলের প্রাণ রাজ্জাক গীতিমালা’ নামের বইটি। এছাড়া গত দশ বছর ধরে তাঁরা দেশের নানা প্রাণ্ত থেকে কবির গানের সংগ্রহ করেন বলে জানান প্রথম আলোকে। এসময় তাঁরা দুজন বলেন, কবির গান সংগ্রহের সাথে কবিপুত্র কাজল দেওয়ানের সম্পর্কই ছিল না।

কবির স্মৃতি রক্ষার জন্য তাঁরা ২০১০ সালে কবির বাড়িতে গঠন করেন মরমি সাধক কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে স্মরণিকা ও ২০২০ সালে বই প্রকাশ করে। তপন বাগচী একটি প্রবন্ধ লেখার কথা বলে দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য সংরক্ষিত গানগুলো নেন। পরে এসব নিয়ে নিজে বই প্রকাশ করেন বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন এই দুই সম্পাদক।

এ সময় তাঁরা জানান, কবিপত্নী নাছিমা দেওয়ান তাঁদের লিখিতভাবে বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন। তপন বাগচী বই প্রকাশের পর নাছিমা দেওয়ান বাংলা একাডেমিতে লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ওই চিঠির অনুলিপিও প্রথম আলোকে দিয়েছেন ইকবাল জাফর ও ।

কবি আব্দুর রাজ্জাকের প্রথম স্ত্রী মাসুমা বেগম মধুমালার একমাত্র সন্তান কাজল দেওয়ান। মাসুমা বেগম মধুমালা ছিলেন পাকিস্তান রেডিওর শিল্পী। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে কবি আব্দুর রাজ্জাক বিয়ে করেন নাছিমা দেওয়ানকে। এ ঘরের ছেলে সুজন দেওয়ান। সুজন দেওয়ান কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।