সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ: ব্যস্ত সড়কে রক্তাক্ত অবস্থায় ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ

বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ
ছবি: প্রথম আলো

সন্ধ্যা ছয়টা। ঘটনাস্থল ঘিরে শত শত উৎসুক জনতা। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত দুটি বহুতল ভবনের নিচের দিকটা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের নিচতলার কলাপসিবল গেট বিচ্ছিন্ন হয়ে সড়কে পড়ে আছে। তার সঙ্গে রয়েছে বিধ্বস্ত একাধিক মোটরসাইকেল, রিকশা-ভ্যান। ভবনের কাচ, ইট, বালুসহ নানা কিছু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল সড়কে। ভবনগুলোর সামনের সড়কে ‘সাভার পরিবহন লিমিটেড’ নামের একটি বাস তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। তবে সেটিও নিয়েছিল ধ্বংসস্তূপের চেহারা।

এ অবস্থা তৈরি হয় ঘণ্টাখানেক আগে (মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে) সিদ্দিকবাজারের নর্থ সাউথ সড়কের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তখন নর্থ সাউথ সড়কের দুই পাশেই যান চলাচল করছিল। সদরঘাট থেকে গুলিস্তানগামী এই সড়ক ঢাকা মহানগরীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক। বিস্ফোরণের পর সড়কের বিভিন্ন অংশে রক্তাক্ত অবস্থায় অনেক মানুষ পড়ে ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই তখন সড়ক দিয়ে চলাচল করছিলেন। তাঁদের কেউ বাসের যাত্রী ছিলেন, কেউ রিকশা-ভ্যানে চড়ে ছিলেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন পথচারী। কেউ কেউ দোকানে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
হতাহত ব্যক্তিদের খোঁজে ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য
ছবি: প্রথম আলো

ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে একটি ভাসমান চায়ের দোকান চালান সোহরাব হোসেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি দোকানে ছিলেন। তিনি মুঠোফোনে ঘটনাস্থলের সামনের কিছু দৃশ্যের ভিডিও করেছেন। সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের পর তাঁর মনে হয়েছিল বোমা ফুটেছে। তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, বহু মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। এসব মানুষকে রিকশা-ভ্যানে করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আরও পড়ুন

বিস্ফোরণের পর ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও সরবরাহ করেছেন সোহরাব হাসান। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সড়কে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে। একটি ভিডিওতে ষাটোর্ধ্ব একজনের ছিন্নভিন্ন লাশ ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। অন্য একটি ভিডিও দেখা গেছে, স্থানীয়রা আহত কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন।

ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

বিস্ফোরণের এ ঘটনায় মোট ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তাঁদের বেশির ভাগকেই বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবন থেকে মৃত বের করে আনা হয়েছে। বিধ্বস্ত ওই সাততলা ভবনের বেজমেন্টে এখনো ঢুকতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা। সেখানে আরও মানুষ আটক থাকতে পারেন বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন।

আরও পড়ুন

চা–দোকানদার সোহরাব হাসানের ভাষ্য, ঘটনার সময় সড়কে যানজট ছিল না। সদরঘাটের দিক থেকে গুলিস্তানগামী যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই দুটি বাসের যাত্রী ছিলেন। আহত ব্যক্তিরা তখন শুধু বাঁচার জন্য সহায়তা চেয়ে আর্তনাদ করছিলেন।

বিস্ফোরণের পর থেকে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা ভিড় করছিলেন। তাঁদের সরাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে। সরিয়ে দেওয়া হলেও তাঁরা আবার ঘটনাস্থলের আশপাশে এসে ভিড় করছিলেন। উৎসুক জনতার কারণে আহত কাউকে উদ্ধার করার পর তাঁদের হাসপাতালে পাঠাতেও বেগ পেতে হচ্ছিল।

স্ট্রেচারে করে বিস্ফোরণে আহত এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন হাসপাতালের কর্মীরা
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিনটি ভবন

ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, বিস্ফোরণ হয়েছে নর্থ সাউথ রোডের ১৮৪ নম্বর ভবনে। ভবনটি সাততলা। ভবনের বেজমেন্ট, নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বেজমেন্ট ছাড়া পুরো ভবনেই তল্লাশি চালিয়েছে।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, সাততলা ভবনটির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার সামনের অংশ ভেঙে মূল সড়কে এসে পড়েছে। সাততলা ভবনটির উত্তর পাশে ১৮০ নম্বর ভবন। এ ভবন পাঁচতলা। ভবনের নিচতলার একটি দোকান পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ভবনেরও প্রতি তলার জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। বিস্ফোরণস্থলের ভবন লাগোয়া দক্ষিণ পাশের সাততলা আরও একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের নিচতলার সিঁড়ির অংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।

সাততলা এই ভবনে ঘটেছে বিস্ফোরণের ঘটনা
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

ক্ষতিগ্রস্ত তিন ভবন থেকে ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। রাত ১১টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবন থেকে ১৫ জনের লাশ এবং ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন বলে সংস্থাটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এ বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত ১৭ জনের লাশ এ হাসপাতালে আনা হয়েছে। আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হওয়া ভবনে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরণের কারণ কী, সেটা এখনো জানা যায়নি। সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিস্ফোরক দল কাজ করছে, তারা এ বিষয়ে একটি উপসংহারে পৌঁছাবে। তিনি বলেন, ভবনের ভেতরে আরও কেউ কেউ থাকতে পারে। তবে কতজন আছে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।

হাসপাতালের সামনে এক নারীর আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ভবনের উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দিনমনি শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভবনের বেজমেন্টে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়েছে। বুধবার সকালে সেনাবাহিনী আসবে, তারপর উদ্ধারকাজ শুরু হবে।

বিস্ফোরণে নিহত একজনের লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হচ্ছে।
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন