বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই বাসায় তেলাপোকা নিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল, তা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা যায় না বলে পুলিশ জানিয়েছে। বাসাটিতে তেলাপোকা নিধনের জন্য কীটনাশক দেওয়া প্রতিষ্ঠান ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড কোম্পানির চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরহাদুল আমিনকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা বিভা-ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, বাসাটিতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফেটসমৃদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁরা বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা সবাই বলেছেন, এই কীটনাশক বড় পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস), বীজগুদাম বা অনাবাসিক এলাকায় ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ঘরে এটা ব্যবহার করা যায় না। আর ব্যবহার করলেও আবাসস্থল ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হয়। এরপর আবার ২৪ ঘণ্টা দরজা-জানালা খোলা রাখতে হয়। তারপর সেখানে বসবাস করা যায়।
কেন তাঁরা এই কীটনাশক ওই বাসায় ব্যবহার করলেন, তাঁরা এটা কোথায় পেয়েছিলেন, সেসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান ও এমডি ফরহাদুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন।
তিনি বলেন, কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিশু দুটির মৃত্যুর পরই আশরাফুজ্জামান ও ফরহাদুল গা ঢাকা দেন। তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থাকেননি। গাড়িতে করে ঘুরেছেন। কখনো টাঙ্গাইল, কখনো নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেছেন। তিন দিন পর আজ সকাল পৌনে আটটার দিকে নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্ত এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের ব্যবহৃত গাড়িটিও ঢাকা মেট্রো (গ ২১- ১৬৫৯) জব্দ করা হয়েছে।
২ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের একটি বাসায় তেলাপোকার কীটনাশক দেন ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেডের কর্মীরা। তাঁরা বলেছিলেন, ৬ ঘণ্টা পর বাসায় আসা যাবে। সেখানে প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে শনিবার ভোররাতের দিকে ওই বাসায় ঢোকেন পরিবারের সদস্যরা। নতুন ফ্ল্যাট কিনে সপ্তাহ দুয়েক আগেই তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেখানে উঠেছিলেন মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান দম্পতি। ওই দিন ঘরে ঢোকার ঘণ্টা দুয়েক পর শারমিন ও তাঁর দুই ছেলে বমি করেন। তখন বাসার জানালা-দরজা খুলে দেওয়ার পাশাপাশি তেলাপোকা নিধনের জন্য ডিসিএস অর্গানাইজেশনের কর্মীদের দিয়ে যাওয়া ট্যাবলেট (কীটনাশক) তুলে বাইরে ফেলা হয়।
পরদিন তাঁরা সবাই স্যালাইনসহ তরল খাবার খান। কিন্তু ৩ জুন রাত শেষে ভোরের দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে পরিবারের ছোট ছেলে ৯ বছর বয়সী শাহির মোবারত (জায়ান)। কাছের এভারকেয়ার হাসপাতালে নিতে নিতে তার মৃত্যু হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহিলের বড় ভাই ১৫ বছর বয়সী শায়ান মোবারত (জাহিন) অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু রাত ১০টার দিকে তারও মৃত্যু হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, এ ঘটনায় দুই শিশুর মা শারমিন জাহান ও বাবা মোবারক হোসেনও বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দুটি ফুটফুটে শিশুসন্তানকে হারিয়ে এই বাবা-মায়ের অবস্থা পাগলপ্রায়। তাঁরা এই ঘটনায় দায়ীদের সুষ্ঠু বিচার চান। আর কোনো বাবা-মাকে যেন এভাবে সন্তানের অকালমৃত্যু দেখতে না হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।
দুই শিশুর অকালমৃত্যুর ঘটনায় ৫ জুন রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন তাদের বাবা মোবারক হোসেন। এ মামলায় এর আগে গত সোমবার রাতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মী টিটু মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে, বাসায় যে দুজন কীটনাশক দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন এই টিটু মোল্লা। পরদিন মঙ্গলবার তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে গ্রেপ্তার করার পর প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাসাটিতে ব্যবহৃত এই কীটনাশকে রাসায়নিকগুলোর অনুপাত সঠিক ছিল কি না, এর অনুমোদন আছে কি না, এটা মানবদেহের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর—এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তাঁরা। পরে তাঁদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব যাচাই-বাছাই করা হবে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থের লোভে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে বিবেচনায় নেননি। তাঁরা ওই পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ না দিয়েই আনাড়ি কর্মচারীদের দিয়ে এই কীটনাশক দিয়েছেন। ফলে দুটি শিশুর জীবন ঝরে গেছে।
সংবাদ সম্মেলন চলাকালে দুই শিশুর বাবা মোবারক হোসেন ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তাঁর সন্তানদের মৃত্যুর জন্য দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘যাঁদের কারণে আমি দুই সন্তান হারিয়েছি, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক, আমি চাই সুষ্ঠু বিচারে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। যেন আর কোনো বাবা-মা এভাবে তাদের আদরের সন্তান না হারায়।’