উত্তর সিটি করপোরেশন
মশা মারতে আনা বিটিআই আমদানি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানের
মশার লার্ভা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমদানি করা জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠেছে। আমদানিকারক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কীটনাশক সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের প্রস্তুত করা বলে দাবি করলেও সেটা সত্য নয় বলে দাবি করছে কোম্পানিটি। এ নিয়ে সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানি নিজেদের ফেসবুক পেজে একটি সতর্কবার্তাও দিয়েছে।
সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সকাল সাতটার দিকে ওই বার্তা শেয়ার করা হয়। এ ঘটনা জানার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে বেস্ট কেমিক্যাল থেকে পণ্য কেনার প্রমাণ দিতে বলেছে উত্তর সিটি করপোরেশন।
সতর্কবার্তায় যা বলা হয়েছে
‘জালিয়াতির সতর্কবার্তা’ (স্ক্যাম অ্যালার্ট) শিরোনামে দেওয়া ওই বার্তায় লেখা হয়, ‘এটা আমাদের নজরে এসেছে যে বাংলাদেশের মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড পণ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) সরবরাহ করেছিল। এতে তারা জালিয়াতির মাধ্যমে (ফ্রডলি) আমাদের কোম্পানির নাম (বেস্ট কেমিক্যাল) বিটিআইয়ের প্রস্তুতকারক হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
সতর্কবার্তায় আরও বলা হয়, বেস্ট কেমিক্যালের মাধ্যমে পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড সরবরাহ করা হয়নি। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বেস্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত কোনো পরিবেশকও নয়। এ ছাড়া মার্শাল অ্যাগ্রোভেট মি. লি শিয়াং নামের এক ব্যক্তিকে বেস্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ দাবি করেছিল, অথচ তিনি বেস্ট কেমিক্যালের কোনো কর্মী নন।
ফেসবুকে দেওয়া ওই বার্তায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে বলা হয়, ‘আমাদের মেধাস্বত্ব আইনের অধিকার লঙ্ঘন করে এমন জালিয়াতি উৎপাদন, বিক্রি এবং বিতরণ অথবা উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণের প্রস্তাব দেওয়া যেকোনো পক্ষের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বেস্ট কেমিক্যাল দ্বিধা করবে না।’
সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালের দেওয়া বার্তায় ঢাকা উত্তর সিটিতে ব্যবহৃত বিটিআই কীটনাশক এবং ওই কীটনাশকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বেশ কিছু ছবি যুক্ত করা হয়।
ই–মেইলের জবাবে যা বলল বেস্ট কেমিক্যাল
এ নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কো. (এস) পিটিই লিমিটেডকে গতকাল বেলা সোয়া তিনটার দিকে একটি ই-মেইল করা হয়। তাতে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কোনো কোম্পানি তাদের কাছ থেকে বিটিআই নামের মশানিধনের কোনো ব্যাকটেরিয়া আমদানি করেছে কি না? এ ছাড়া মার্শাল অ্যাগ্রোভেট থেকে ঢাকা উত্তর সিটিকে সরবরাহ করা বিটিআইয়ের প্রস্তুতকারক তারা (বেস্ট কেমিক্যাল) কি না?
পরে বেলা ৩টা ৩৯ মিনিটে বেস্ট কেমিক্যাল থেকে প্রথম আলোর মেইলের উত্তর দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে মেইলটি করেন জনি ওং নামের এক কর্মকর্তা। ই-মেইলে বলা হয়, তাঁদের কোম্পানি থেকে ঢাকা উত্তর সিটিকে পাঁচ টন বিটিআই সরবরাহ করা হয়নি। ই-মেইলের ওই বার্তার নিচে তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া ওই সতর্কবার্তার লিংকও যুক্ত করা হয়।
মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের সাড়া নেই
মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সদস্য। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় পুরানা পল্টনের বায়তুল আবেদ ভবনের ৯ম তলায়। বিএফএর ওয়েবসাইটে থাকা সদস্যদের বিস্তারিত তথ্যের জায়গায় প্রতিষ্ঠানটির একটি মুঠোফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। নম্বরটি মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের মালিক মো. আলাউদ্দিনের। ওই নম্বরে বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে কল করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ ফোন ধরেননি। এরপর বিকেল ৫টা ২৪ মিনিটের পরে আবার দুবার কল দেওয়া হয়। নম্বরটি তখন বন্ধ পাওয়া যায়।
যা বললেন উত্তর সিটির কর্মকর্তারা
মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, যিনি আমদানি করেছেন এটা তাঁর দায়িত্ব, তিনি কার কাছ থেকে এনেছেন। এর মধ্যে তিনি যদি অন্য কোনো কিছু করে থাকেন, তাহলে তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। তবে সিটি করপোরেশন পণ্যটি দাপ্তরিকভাবে এখনো গ্রহণ করেনি, বিলও দেয়নি। শুধু নমুনা হিসেবে পরীক্ষা এবং ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে গত সোমবার (৭ আগস্ট) মশানিধনে বিটিআইয়ের প্রয়োগ শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি। সেদিন ডিএনসিসির অঞ্চল ৩-এর আওতাধীন গুলশান-২ নম্বরের ৪৭ নম্বর সড়ক এলাকায় এ কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। ওই সময় সেখানে লি শিয়াং নামের একজনকে বিটিআই কীটনাশকের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই ব্যক্তিকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল তাদের কর্মী এবং কীটনাশক বিশেষজ্ঞ নন বলে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো ব্যবহারকারী পর্যায়ের। আমদানি হয়েছে ভান্ডার ও ক্রয় শাখা থেকে। তারাই ওই ব্যক্তিকে আমাদের কাছে সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানির কর্মী এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তারাই এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে তিনি সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
প্রমাণ দিতে হবে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে
বিটিআই বিতর্ক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে বলা হয়েছে, আপনারা যে বলছেন সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল থেকে এনেছেন, কীভাবে এনেছেন, এর প্রমাণ সিটি করপোরেশনে জমা দিতে।’
মেয়র আতিক আরও বলেন, ‘আমরা মূলত বিটিআই—এই কীটনাশকই নিয়ে আসতে চেয়েছি। এ ক্ষেত্রে পিপিআরের নীতিমালা শতভাগ অনুসরণ করা হয়েছে। দরপত্রে যে ঠিকাদার সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন, তাদের বিষয়টি উল্লেখ করে প্ল্যান প্রটেকশনকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে আমরা যে কারও কাছ থেকে বিটিআই নিতে পারি কি না? তারা সম্মতি দিয়েছে।’
ঠিকাদারকে কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি দাবি করে মেয়র আতিক বলেন, আইইডিসিআরকে বিটিআইয়ের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। প্ল্যান প্রটেকশন পরীক্ষা করছে, যেটা আনা হয়েছে, সেটা আসলেই বিটিআই কি না। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফল জানা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।