ঢাকা উত্তর সিটিতে গৃহকরের টাকা ‘আত্মসাৎ’, যাচ্ছে কার পকেটে

গৃহকর পরিশোধের বিপরীতে ভুয়া রসিদ দেওয়া হয়েছে। পোর্টাল থেকেও কর পরিশোধের লেনদেনের তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরের মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা মারুফ হোসেন। গৃহকর পরিশোধে ভুয়া রসিদ পাওয়া নিয়ে ৬ আগস্ট ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।

অভিযোগে লিখেছেন, গত ২২ জানুয়ারি তিনি ডিএনসিসির অঞ্চল-২–এ একটি বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট শাখায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের গৃহকর বাবদ ৪২ হাজার ৭ টাকা পরিশোধ করেন। পরে গত ১১ জুলাই চলতি অর্থবছরের কর পরিশোধ করতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর গত অর্থবছরের টাকাই বকেয়া আছে।

এ ঘটনায় যোগাযোগ করলে মিরপুরে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মারুফকে জানান, কর পরিশোধের যে রসিদ তাঁকে দেওয়া হয়েছে, সেটা ভুয়া। পরে কর পরিশোধের তথ্যসংক্রান্ত ঢাকা উত্তর সিটির ওয়েবসাইটের নাগরিক পোর্টালে গিয়ে দেখেন, তাঁর কর পরিশোধের লেনদেনের তথ্যও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

কেউ যদি প্রতারণা বা ছলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএনসিসি ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহনশীলতা) প্রদর্শন করবে।
সেলিম রেজা, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএনসিসি

এ বিষয়ে গত রোববার সন্ধ্যায় মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনারা (সিটি করপোরেশন) এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। দেখি কী সমাধান দেন।’

শুধু মারুফ হোসেনই নন, গৃহকর পরিশোধে ভুয়া রসিদ পাওয়া নিয়ে ডিএনসিসিতে এখন পর্যন্ত সাতজন ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মারুফসহ তিনজনের অভিযোগের অনুলিপি প্রথম আলোর হাতে এসেছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, গৃহকর পরিশোধের বিপরীতে তাঁদের ভুয়া কিংবা জাল রসিদ দেওয়া হয়েছে। টাকা জমা দেওয়ার পর নাগরিক পোর্টালে তাঁদের কর পরিশোধের বিষয়টি হালনাগাদ দেখানো হয়েছিল। এখন চলতি অর্থবছরের টাকা জমা দিতে গিয়ে দেখছেন, আগের তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, করের টাকা পরিশোধই হয়নি।

উত্তর সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে গৃহকর আদায়ে ‘রেভিনিউ অটোমেশন সিস্টেম’ পরিচালনায় করপোরেশন থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের একটি চক্র গ্রাহকদের ভুয়া রসিদ দিচ্ছে। চক্রটি জালিয়াতি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ করের টাকা আত্মসাৎ করেছে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা রোববার প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যদি প্রতারণা বা ছলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। এ ব্যাপারে ডিএনসিসি ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহনশীলতা) প্রদর্শন করবে।

কর্তৃপক্ষ কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও উল্টো জালিয়াতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আ ন ম তরিকুল ইসলামকে সম্প্রতি অন্যত্র বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

খাদিজা খাতুন নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, তিনি গত ২২ মার্চ ৩১ হাজার ২০০ টাকা গৃহকর পরিশোধ করেন। পরে ২৮ মে ২০২২-২৩ অর্থবছরের কর পরিশোধ করতে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘রেভিনিউ অটোমেশন সিস্টেম’ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি তাঁকে আগের টাকা পরিশোধের কাগজ দেখাতে বলেন। কাগজ দেখালে তিনি জানান, সেই টাকা জমা হয়নি।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য

জালিয়াতির বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ নিয়ে ৮ আগস্ট ঢাকা উত্তর সিটির নগরভবনে একটি সভা হয়। সভায় খাদিজা খাতুন নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, তিনি গত ২২ মার্চ ৩১ হাজার ২০০ টাকা গৃহকর পরিশোধ করেন। পরে ২৮ মে ২০২২-২৩ অর্থবছরের কর পরিশোধ করতে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘রেভিনিউ অটোমেশন সিস্টেম’ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি তাঁকে আগের টাকা পরিশোধের কাগজ দেখাতে বলেন। কাগজ দেখালে তিনি জানান, সেই টাকা জমা হয়নি।

এ নিয়ে খাদিজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনারা (সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ) বলেছেন, বাইরে এ নিয়ে আলোচনা না করতে। উনারা বিষয়টি সমাধান করে দেবেন।’

আরেকজন ভুক্তভোগী শফিকুর রহমান সভায় বলেন, তিনি ২০২২-২৩ অর্থবছরের গৃহকর বাবদ গত ১ মার্চ ১ লাখ ১২ হাজার ৫৭৬ টাকা ৭৩ পয়সা পরিশোধ করেন। ১৩ জুলাই চলতি অর্থবছরের করের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন, কর জমা দেওয়ার বিষয়টি সার্ভারে হালনাগাদ করা হয়নি, অর্থাৎ বকেয়া রয়েছে। একইভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শংকর দয়াল বিশ্বাসও জানান, তিনি গত ৪ সেপ্টেম্বরে টাকা জমা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। পরে চলতি অর্থবছরের জন্য লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলে তাঁকে বলা হয়, আগের অর্থবছরের টাকা বকেয়া রয়েছে।

আরও পড়ুন

ফৌজদারি মামলার সিদ্ধান্ত

সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, প্রথম সিদ্ধান্ত হচ্ছে, অনলাইনে গৃহকর প্রদানে ভুয়া বা জাল রসিদের ব্যবহার এবং প্রতারণার মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেভিনিউ অটোমেশন সিস্টেম পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি যাঁরা সফটওয়্যার থেকে তথ্য মুছে ফেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, উত্তর সিটির সব আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বেসরকারি ওই ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকের এজেন্ট শাখা দ্রুত সরানো হবে। তৃতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, রেভিনিউ অটোমেশন সফটওয়্যারে কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা চিহ্নিত করা হবে।

কর্মকর্তারা যা বলেছেন

সভায় ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহ. আমিরুল ইসলাম বলেন, রেভিনিউ অটোমেশন সিস্টেমে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে, তা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব। ডিএনসিসির সচিব মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, অনিয়মে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

সভায় মিনিট দশেক অবস্থানের সুযোগ পান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অনেকটা তর্কে জড়ান।

সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা তরিকুলের বক্তব্যেও সেটা স্পষ্ট। তিনি বলেন, নতুন সিস্টেম (রেভিনিউ অটোমেশন) নিয়ে কথা বললে তিনি সিস্টেমবিরোধী হয়ে যাবেন, এটা ঠিক নয়।

আরও পড়ুন

প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক প্রতিনিধিদের বক্তব্য

সভায় উপস্থিত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সৈয়দ সোহেল তানভীরের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এন্ট্রি করার পর পোর্টাল থেকে কেন ডেটা ডিলেট করা হলো? এর সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি। তবে শুধু প্রোগ্রামার, সহকারী প্রোগ্রামার ও সুপারভাইজারদের পোর্টাল থেকে তথ্য মুছে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

বেসরকারি যে ব্যাংকের রসিদ দিয়ে এমন জালিয়াতি হচ্ছে, সেই ব্যাংকের একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আসলাম ফেরদৌস বলেন, রসিদ যেহেতু ম্যানুয়াল নয়, তাই এখানে একাধিক সংস্থার যোগসাজশ রয়েছে। টেকনিক্যাল সাপোর্ট বা ইনফরমেশন ছাড়া রসিদ বের করা সম্ভব নয়। জড়িতদের চিহ্নিত করতে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যদি (জালিয়াতি) ধরা পড়ে, আইনে যা যা করা দরকার, সবকিছু করা হবে।