মতবিনিময় সভায় বক্তারা
সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরও স্বীকৃতি দিতে হবে, অস্তিত্বের সংকট দূর করতে হবে
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যদি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে চায়, তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখতে হবে। সংবিধানে তাদেরও স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নাম সংবিধানে লিখিতভাবে থাকতে হবে। তারা যে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে, সেটির স্থায়ী ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিকল্প নেই। ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংবিধান দর্শন: জুলাই গণ–অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী জাতিসমূহের অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক একটি বাহাস ও মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে সভার আয়োজন করে ‘মাওরুম জার্নাল ও আইপিনিউজবিডি।
বাহাস ও মতবিনিময় সভার সূত্রধার লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চিন্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রজন্ম যে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের দাবি তুলেছে—যেখানে ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশ’ এই চেতনা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দার্শনিকতা ও সাম্যবাদের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। নতুন প্রজন্মের গ্রাফিতি ও রাজনৈতিক চেতনায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব এবং উন্নয়নের নামে নিপীড়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কথা বলি। অথচ আমাদের সংবিধান পুরুষতান্ত্রিক, এটি কেবল পুরুষের; আমাদের সংবিধান কেবল বাঙালির, এতে অন্য জাতির অধিকারের কথা নেই। এই সংবিধান কেবল মুসলমানের, অন্য ধর্মের না; আমাদের সংবিধান কেবল বাংলা ভাষার, অন্য কোনো ভাষার অধিকার এই সংবিধানে নেই। তাহলে কেমন করে ইনক্লুসিভ হয়?’
ইনক্লুসিভের (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ব্যখ্যায় বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেন রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছাত্র প্রতিনিধিদের থেকে দুজন উপদেষ্টা হয়েছেন যাঁরা দুজনই ছেলে, তাহলে ইনক্লুসিভ কীভাবে হয়? বিদ্বেষী মন্তব্য দিয়ে একটি গোষ্ঠীর চাপে আমাদের দুজন শিক্ষককে একটি কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হলো। এটা ইনক্লুসিভ কীভাবে হয়?’ তিনি বলেন, প্রতিটি জাতির (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) নাম সংবিধানে লিখিতভাবে থাকতে হবে। তারা যে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে, সেটির স্থায়ী ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিকল্প নেই।
ক্ষমতার ঝোঁকই হচ্ছে স্বৈরাচারী হওয়া মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, ‘এই সরকারও যদি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকে, তারাও স্বৈরাচার হয়ে উঠবে। এ জন্য সরকারকে চোখে চোখে রাখতে হয়, প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হয়, সমালোচনা করতে হয়। এই সংবিধান এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন আর কোনো হাসিনা তৈরি না হতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সরল বানানোর ডিসকোর্সের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়। দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্ধারণে আলোচনা করা উচিত। এত দিন হয়ে গেল একটা আলোচনাও হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ সালের যে বিষয়গুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ক্ষুণ্ন করে, সেগুলো সংস্কার করা দরকার। শুধু তা–ই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যে বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক, সেগুলোর বিষয়েও কাজ করা জরুরি।
আমেনা মহসিন আরও বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) সংবিধানের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা শ্রেণি ও জাতিগত বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সবার স্বার্থকে সুরক্ষা দেবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় তিনি রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের ওপর একতরফা জোর দেওয়ার বিরোধিতা করেন। কারণ, এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মাওরুম জার্নালের সম্পাদক ও মানবাধিকারকর্মী দীপায়ন খীসা। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যদি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে চায়, তাহলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখতে হবে। ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আমরা যে আওয়ামী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়ছি, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেই ১৯৭২ সালে গণপরিষদ বিতর্কে একাই লড়াই করেছিলেন। তিনি কাঠামোগতভাবে সংবিধানকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি বহুত্ববাদের চিন্তা করেছিলেন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে আমরা সব সময় ঔপনিবেশিক চশমা দিয়ে দেখি। এ চশমাটি খুলে আদিবাসীরাও যে দেশের গর্বিত নাগরিক, তাদের যে অধিকার রয়েছে, সে অধিকারও সুরক্ষা করতে হবে। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের সমতল অঞ্চলেও যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের কোনো প্রতিনিধি না থাকার কথা উল্লেখ করে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের যে নতুন সুযোগ এসেছে সেখানে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ন্যায় ও ন্যায্যতা এবং মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের আরও লড়াই করে যেতে হবে।’
নতুন সংবিধানে নাগরিক মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘আমরা যে এক দফার ভিত্তিতে আন্দোলন করেছিলাম, সেটি এখনো সফল হয়নি। তবে এ আন্দোলনের ফলে নতুন করে প্রশ্ন করার সুযোগ এসেছে, আলাপ–আলোচনার সুযোগ এসেছে। এ আলাপ–আলোচনার পরিসর যেন শেষ না হয়। আমাদের সংবিধান একটি অভিশপ্ত সংবিধানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নাগরিক মর্যাদাকে বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হয়, কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান এটি করতে ব্যর্থ।’
আইনজীবী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সায়ক চাকমা বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী একটি বড় স্টেকহোল্ডার। আমরা একটি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। একটি বড় রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে পরাভূত করে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে, সে সংস্কারে আদিবাসীদের ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে অংশীদারত্ব রাখতে হবে।’
বাহাস ও মতবিনিময় সভাটি পরিচালনা করেন আইপিনিউজ–এর উপসম্পাদক সতেজ চাকমা। এ সময় আরও বক্তব্য দেন কবি মিঠুন রাকসাম ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য অনিক রায়।