গুলশানের অভিজাত বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ কলাগাছ দিয়ে বন্ধ করলেন মেয়র
নিয়ম অনুসারে বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ দেওয়ার কথা ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালায়। আর যেখানে ওই নালা নেই, ওই এলাকার বাড়ির মালিককে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সেপটিক ট্যাংক স্থাপন করে নিতে হবে। কিন্তু এই দুটির কিছুই না করে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন করা হচ্ছিল সিটি করপোরেশনের খোলা নালায়। আর সেই নোংরা ও বিষাক্ত তরল বর্জ্য নালা থেকে খাল কিংবা লেকে গিয়ে পড়ছিল। গুলশানে এমন অভিজাত বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ কলাগাছ ঢুকিয়ে বন্ধ করলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা গুলশান-২ নম্বরে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। মেয়রের উপস্থিতিতে এ সময় অবৈধভাবে উন্মুক্ত নালায় পয়োবর্জ্য অপসারণ করা দুটি বাসাবাড়ির সংযোগে কলাগাছের খণ্ডিত অংশ ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বাসাবাড়ির মালিককে এ নিয়ে সতর্ক করেন। দ্রুত পয়োবর্জ্যের সংযোগ ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালায় যুক্ত করতে অথবা সেপটিক ট্যাংক স্থাপন করতে নির্দেশ দেন তিনি।
সরেজমিনে গুলশান-২ নম্বরের ১১২ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তরল পয়োবর্জ্য সরাসরি সিটি করপোরেশনের খোলা নালায় এসে পড়ছে। ১০২ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে গিয়ে একই চিত্র দেখা গেল। পরে অভিযান চালিয়ে ওই দুটি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগেই কলাগাছের খণ্ডিত অংশ ঢুকিয়ে দিয়ে নালার বর্জ্যের প্রবাহ বন্ধ করে দেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
এর মধ্যে প্রথম অভিযান চালানো ১৩ নম্বর বাড়িতে মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে ৪ নম্বর বাড়ির মালিক তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ২০১৬ সালে সিটি করপোরেশন থেকে এখানে জরুরিভাবে রাস্তা ও নালা সংস্কারের কাজ করা হয়েছিল। ১৫ দিনের মধ্যে করা ওই কাজের সময় তড়িঘড়ি করে কাজ করতে গিয়ে তাঁর বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ কেটে ফেলা হয়। পরে সমস্যা হবে দেখে তারাই ওই সংযোগ খোলা নালায় যুক্ত করে দিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘এত দিন বিষয়টি আমরা জানতামই না। কারণ, ওয়াসাকে পয়োনিষ্কাশনের বিল নিয়মিত পরিশোধ করছি। গতকাল এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের লোকজন আসলে আমি সড়ক কাটার অনুমতির জন্য আবেদন প্রস্তুত করেছি। নতুন করে ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালার সঙ্গে আমার বাড়ির পয়োবর্জ্যের পিট সংযোগ করতে হবে। কিন্তু এখন আমার সংযোগ কলাগাছ ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিয়ে গেছে।’
অভিযানের একপর্যায়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন সোসাইটির নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, আমি অনুরোধ করব, অনতিবিলম্বে আপনারা সোসাইটিতে বসেন। এখন অনেক আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। এসব ভবনে আপনারা বিভিন্ন প্রয়োজনে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। তাহলে কেন আপনারা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারবেন না?’
মেয়র বলেন, গুলশান সোসাইটির নবনির্বাচিত কমিটির নেতারা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা এ বিষয়ে তিন মাস সময় চেয়েছিলেন। তিনি ছয় মাস সময় দিয়েছেন। আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযান আরও আগে সেপ্টেম্বর মাসে করার কথা ছিল। তখন না করে এই জানুয়ারিতে এসে করছি। কিন্তু জরিপ চালিয়ে যে ফল দেখলাম, পরিবর্তনের পরিমাণ অতি নগণ্য। তারা হয়তো মনে করেছিল, কিছুই হবে না।’
সবাইকে বার্তা দিতে চান জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘যেসব বাড়ি থেকে পয়োবর্জ্য সরাসরি খোলা নালায় সংযোগ দেওয়া হয়েছে, আপনারা কি চান কলাগাছ ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে আপনাদের বাড়িতে তরল বর্জ্য উপচে পড়ুক? যে কয়টা বাড়িতে আমি কলাগাছ ঢুকিয়েছি, ওরা কিন্তু পাগল হয়ে গেছে।’
নিজের বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক স্থাপন করেছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নগরের মেয়র হিসেবে আমাকেও প্রশ্ন করতে পারেন। সব সাংবাদিককে আমার বাসায় যাওয়ার অনুরোধ জানাই। উত্তরাতে আমার বাসায় আসুন, আমার বাসাতেও আগে পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় যেত। এখন বাড়ির পার্কিংয়ের জায়গার নিচে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসিয়েছি। এটি জাপানের জোকোসো মডেলের। মাত্র দুই সপ্তাহ গাড়িগুলো বাইরে রাখতে হয়েছে।’
মেয়র আরও বলেন, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানোয় যে পানি এখন অবমুক্ত হচ্ছে, সেটি জীববৈচিত্র্যের জন্য ভালো। সবাই যাঁর যাঁর বাড়িতে এটি স্থাপন করতে পারেন। এতে লেক–খাল সুন্দর ও পরিষ্কার থাকবে। সেখানে মাছ চাষ করা যাবে। বাচ্চারা নৌকা চালাতে পারবে। সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি হবে।
ওয়াসা যে কাজের জন্য নগরবাসীর কাছ থেকে বিল নিচ্ছে, সে সেবা তারা দিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে জরিপ করার আহ্বান জানান মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিল নিলে সেবাও দিতে হবে। আপনারা বিল নেন কিন্তু সেবা দেন না, এতেই এই অবস্থা। বিল নিচ্ছেন আপনারা (ওয়াসা), তরল পয়োবর্জ্য যাচ্ছে করপোরেশনের নালায়, খালে ও লেকে।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন এবং গুলশান পূর্ব ও পশ্চিমের ৩ হাজার ৮৩০টি বাড়িতে জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬৫টি বাড়িতেই পয়োবর্জ্য সরাসরি উন্মুক্ত নালা, খাল কিংবা লেকে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় মিশছে।