ঢাকা থেকে অপহৃত তরুণ মেঘালয়ে উদ্ধার

কাজী হাসিবুর রহমানছবি: সংগৃহীত

সদ্যই বাবাকে হারিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিএটির ছাত্র কাজী হাসিবুর রহমান। ফলে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার ভার পড়েছিল তাঁর ওপরই। ব্যবসার প্রয়োজনে গত ২৬ ডিসেম্বর উত্তরার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। প্রায় এক মাস পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে উদ্ধার করে।

পুলিশ বলছে, অপহরণের পর হাসিবুরকে মেঘালয়ে নিয়ে গিয়েছিল অপহরণকারীরা। একটি সংঘবদ্ধ অপহরণ ও পাচারকারী চক্র তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ঢাকা পুলিশের অনুরোধে পরে মেঘালয় পুলিশও অপহৃত তরুণকে উদ্ধারে অভিযান চালায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (গোয়েন্দা) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ, সুনামগঞ্জের স্থানীয় পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় ২৩ জানুয়ারি অপহরণকারীদের চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের কিছু পর ঘটনাস্থলে র‌্যাব সদস্যরা উপস্থিত হন। পরে র‌্যাব দুজন আসামি নিয়ে হাসিবুরকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। পাহাড়ি অঞ্চলে তীব্র কুয়াশার কারণে গত কয়েক দিন ওই অঞ্চলে অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। বুধবার রাতে র‍্যাব এক খুদে বার্তায় হাসিবুরকে উদ্ধারের খবর জানায়।

এর আগে হাসিবুরের মা তহুরা হক বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের অনুপস্থিতিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে আজই (বুধবার) জানিয়েছিল ছেলে দ্রুতই ফিরবে।

কিন্তু ঢাকার ছেলে হাসিবুর মেঘালয়ে গেলেন কী করে?

পুলিশ প্রথম আলোকে জানায়, আসলে হাসিবুরের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক সামিদুল ছক কষতে শুরু করেন। হাসিবুরের পরিবারের লোকজন সামিদুলকে বিশ্বাস করতেন। কোন কোন ব্যাংকে তাঁদের টাকাপয়সা রাখা আছে, সেসব খবরই ছিল সামিদুলের কাছে। লোভে পেয়েছিল তাঁকে। তিনি উত্তরায় যে দলের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন, তাঁদের কাছে বলেছিলেন, ‘ম্যাডামের’ ভালো টাকাপয়সা আছে। একটু বুদ্ধি খাটালেই তিনি সব টাকার মালিক হতে পারেন। দলের অন্যতম সদস্য আবদুল মালেক তাঁকে আশ্বস্ত করেন। প্রায় সাড়ে তিন বছর জেল খেটে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মালেক ছাড়া পান। সেবার তিনি অপহরণ করেছিলেন ময়মনসিংহের এক অধ্যাপকের ছেলেকে।

আটজনের দলটি অপহরণের সময় হিসেবে নির্বাচনের আগের সময়টাকে বেছে নেয়। তাদের যুক্তি ছিল নির্বাচনে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। মোটামুটি নির্বিঘ্নে অপহরণের কাজটা সারা যাবে। মুক্তিপণ পেতেও বেগ পেতে হবে না।

২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে শেরপুরের দিকে রওনা হন কাজী হাসিবুর। এই ব্যবসার খবরও সামিদুলের দেওয়া। দুই ঘণ্টা পর তহুরা হক ছেলের ফোন বন্ধ পান।

হাসিবুরের মা ২৬ ডিসেম্বরই ছেলে ও গাড়িচালক নিখোঁজ জানিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন। দিন কয়েক পর থেকে তাঁর মুঠোফোনে মুক্তিপণের টাকা চেয়ে ফোন দিতে শুরু করেন অপহরণকারীরা। টাকার অঙ্ক দুই কোটি। ছেলের ভিডিও পাঠান তাঁরা। সেসব ভিডিওর কোনোটিতে দেখা যায়, হাসিবুরের গায়ের জামা খুলে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে, আবার কোনোটিতে তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে লাঠি দিয়ে বেদম মারা হচ্ছে। ছেলে ‘মা’, ‘মা’ বলে চিৎকার করেন। তহুরা একমাত্র ছেলের জন্য কান্নাকাটি করেন, বলেন তিনি টাকা দিতে রাজি আছেন।

পুলিশ মুঠোফোন নম্বর ধরে অপহরণকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু নম্বরগুলো ভারতীয়। গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া খবর ও ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে অপহরণকারীরা হাসিবুরকে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করে দিয়েছেন। এবার পুলিশ ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভারতের মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি হিলস জেলার ননগ্লাম থানার পাহাড়ি এলাকায় ঢাকার পুলিশের তথ্যে অভিযান শুরু করে মেঘালয়ের পুলিশ। ঢাকায় গোয়েন্দা বিভাগ এই দলের দুই নারী সদস্য রুবিনা ও কামরুন্নাহারকে গ্রেপ্তার করেন।

পুলিশ জানতে পারে, পরিকল্পনা অনুযায়ী অপহরণকারী দলটির কয়েকজন সদস্য ঘটনার দিন হাসিবুরের গাড়ি অনুসরণ করছিলেন মোটরসাইকেলে। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় এসে অপহরণকারীদের কেউ কেউ গাড়িতে উঠে বসেন। তাঁদের একজন মাসুদ, তিনি গাড়িটি চালিয়ে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানায় যান। ধোবাউড়ায় এক বড় চোরাচালানকারীর বাসায় হাসিবুরকে দুদিন আটকে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাঁকে মেঘালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

হাসিবুরকে মেঘালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার পর মাসুদ গাজীপুরের বাসন এলাকায় গাড়িটি ফেলে যান। তিনিই বাংলাদেশ থেকে অপহরণকারী দলের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। মাসুদকেও সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানতে পেরেছে, ঢাকা থেকে মেঘালয় পর্যন্ত বিস্তৃত এই নেটওয়ার্কের সদস্যদের মধ্যে যেমন পেশাদার অপহরণকারী আছেন, তেমনি আছেন পাচারকারীরাও। তাঁরা নিয়মিত মেঘালয়ে যাওয়া–আসা করেন, জিনিসপত্র পাচারও করেন। মেঘালয়ে পাচার করায় নেতৃত্ব দেন রনি নাবাল। তিনিও বছর কয়েক আগে অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সীমান্তের দুই পারেই অপহৃতদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ শুরু থেকেই এই অপহরণ মামলার ছায়া তদন্ত করছিল। লালবাগ বিভাগের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের দিন তিনেকের মাথায় তাঁরা বুঝতে পারেন হাসিবুর আর বাংলাদেশে নেই। পুলিশ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা, সুনামগঞ্জের তাহেরপুরে কয়েকবার অভিযান চালায়। কিন্তু কিছুতেই অপহরণকারীদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাঁরা স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় অপহরণকারীদের ছবি গ্রামের লোকজনের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন। দুর্গম পাহাড়ের এই পারে হাওর, অন্য পারে ভারতের মেঘালয়। সেখানে ঘন জঙ্গল, পাহাড়।  

ওদিকে ভারতের পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এই লোকই অপহরণকারীদের কাছে মুঠোফোনের সিম বিক্রি করেছিলেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় পুলিশ অপহরণকারীদের পালিয়ে থাকার সম্ভাব্য জায়গাগুলোয় অভিযান চালায়। বেশ কয়েকটি আস্তানা থেকে ফোন নম্বর লেখা খাতা, কাগজপত্র, মুঠোফোন উদ্ধার করে তারা। কিন্তু অপহরণকারীরা অধরাই থেকে যান।

২৩ জানুয়ারি স্থানীয় বাসিন্দারা গোয়েন্দা বিভাগ, সুনামগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার, মধ্যনগর ও তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, টেকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে খবর দেন হাওরে একটা নৌকায় কয়েকজন অপহরণকারীকে দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ হাওরে গিয়ে মো. আবদুল মালেক, গাড়িচালক সামিদুল, মানিক মিয়া ও মোবারক হোসেনকে ধরে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে র‌্যাব হাজির হয়। তারা দুজন আসামিকে বিজিবির ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে হাসিবুরকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হয়।

অপহরণকারীরা জানান, তাঁরা বাংলাদেশে এসেছিলেন কিছু বাজার করতে। এসে যে ধরা পড়ে যাবেন, সেই চিন্তা করেননি।

পুলিশ বলছে, হাসিবুরের মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামিকে বুধবার পুলিশ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত তাঁদের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।