দেশে ফিরে বিভিন্ন সেবা নিয়েছেন ১ হাজার ৮৩০ জন প্রবাসী কর্মী। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ জন এসেছেন স্বাস্থ্যসেবা নিতে। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ এসেছেন মানসিক সমস্যা নিয়ে। যাঁরা এসেছেন, তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশ নারী এবং ৩৯ শতাংশ পুরুষ। নারী বেশি এলেও তাঁদের চেয়ে পুরুষ কর্মীরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বেশি এসেছেন। মানসিক সমস্যা নিয়ে যাঁরা এসেছেন, তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ।
মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে ফেরা ১ হাজার ৯৬ জন বিদেশফেরত কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন তাঁরা। কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ জেলায় গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করেছে তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)।
আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য: আর্থসামাজিক উন্নয়নে গোপন অভিবাসন খরচের বোঝা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপের পাশাপাশি বিশদ সাক্ষাৎকার ও দলবদ্ধ আলোচনার মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শাহীন বলেন, ফিরে আসা প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা প্রতিবেদনটি সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে। সরকারের আরও অনেক কিছু করার আছে। কোথাও একটা সমন্বয়ের ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে নিয়মিত উপায়ে অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারলেই সমস্যার ৫০ শতাংশের বেশি সমাধান হয়ে যাবে। প্রবাসীদের তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানানোর একটা সমাধান বের করতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, অধিকাংশ কর্মী গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ শতাংশ কর্মী ফিরে এসেছেন সৌদি আরব থেকে। প্রবাসীরা কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে ঋণ করে টাকা নিয়েছেন। চিকিৎসা করাতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছেন অনেকে। দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব খরচের কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই। তাই সামাজিক খরচের বিষয়টি পুরোপুরি বের করা যায়নি। এর ফলে অভিবাসনের গোপনীয় খরচের হিসাব করা কঠিন। দৃশ্যমান অভিবাসন খরচও অনেক চড়া। নারীদের কোনো অভিবাসন খরচ নেই। অথচ ৬৬৬ জনের মধ্যে ২১ শতাংশ নারী বলেছেন, দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে তাঁদের। আর ২৯ শতাংশ পুরুষ কর্মী বলেছে, ৬ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হয়েছে।
যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে প্রবাসীরা ফিরে এসেছেন, তার মধ্যে আছে পিঠে ব্যথা, কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় আঘাত, হৃদ্রোগ, কিডনি সমস্যা, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, টিউমার, ত্বকের রোগ। আর মানসিক সমস্যার অভিযোগ করেছেন বেশি গৃহকর্মীরা। এরপর আছে কৃষি, নির্মাণ অবকাঠামো, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
দালালের প্রলোভনে পড়ে পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরবে যান নরসিংদীর শেফালি বেগম। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজ করাত, কিন্তু খাবার দিত না। শারীরিকভাবে নিপীড়ন করতেন গৃহকর্তা। অভিযোগ করলে উল্টা মারধর করতেন। হাত ভেঙে দেন, চিকিৎসা করাতেন না। পরে শেফালি দেশে ফিরে আসেন। মামলা করলেও পরে স্থানীয় লোকজনের চাপে ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণে দালালের সঙ্গে সমঝোতা করে মামলা প্রত্যাহার করে নেন।
এক দালালের মাধ্যমে কোম্পানির চাকরি করতে চার লাখ টাকায় সৌদি আরবে যান নারায়ণগঞ্জের মোছা. হানিফা। তিনি বলেন, গিয়ে চাকরি পাননি। একটি কক্ষে তাঁকে ২০ থেকে ২৫ জনের সঙ্গে রাখা হয় কিছুদিন। এক মাস হাজিদের বাসায় কাজ করিয়ে বের করে দেয়। এরপর হানিফা অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিডনির সমস্যা ও বহুমূত্র রোগ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন।
বিএমইটির উপপরিচালক রেজওয়ানুল হক চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে কম বাজেট ও জনবলের মন্ত্রণালয় এটি, তবে প্রত্যাশা বেশি। সীমাবদ্ধতা অনেক। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, বিদেশে যাওয়া কর্মীদেরও কিছুটা দায়িত্ব নিতে হবে। যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতন হয়ে গেলে সমস্যা কমে যায়।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, যে পরিমাণ কর্মী গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে, সেভাবে প্রবাসী আয় বাড়েনি; তার মানে সবাই গিয়ে কাজ পাননি। নারী কর্মী তো ওখানে ঘর থেকেই বের হতে পারেন না। কল্যাণ বোর্ডের টাকা ফেলে না রেখে প্রবাসী কর্মীদের জন্য কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করা উচিত।
গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, একজন কর্মীও যদি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দেশে ফেরত আসেন, তার মানে তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক সমস্যায় নারীদের নানা সেবা দেওয়া হলেও পুরুষদের বিষয়টা উপেক্ষিত থাকে। অথচ এ গবেষণা বলছে, পুরুষের মানসিক সমস্যা বেশি।