শিশুদের নাগালের বাইরে খেলার মাঠ

দেশের নগর এলাকার খেলার মাঠ নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারিছবি: প্রথম আলো

‘বছরখানেক ধরে মাঠটিতে শিশুরা খেলতে পারছে না। জানতে চাইলে বলা হয়, উন্নয়নকাজ চলছে। আমরা বয়স্করা অবশ্য মাঠে থাকা ভবনের ছাদে ব্যায়াম করতে পারি। আমাদের বের করে দেয়নি, শিশুদের বের করে দিয়েছে।’ রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আবাহনী মাঠে শিশুদের খেলতে না পারা নিয়ে এমন আক্ষেপ করলেন এইচ এম নুরুল ইসলাম। তিনি ধানমণ্ডি কচিকণ্ঠ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে খেলার মাঠের সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সভায় নুরুল ইসলাম আরও জানান, আগে তিনি স্কুলের শিশুদের খেলার জন্য মাঠে নিয়ে যেতেন। এখন শিশুদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ‘দেশের নগর এলাকার খেলার মাঠের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে যৌথভাবে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট।

সভায় নুরুল ইসলামের মতো এমন আক্ষেপ ছিল আরও অনেকের। কেউ বলেছেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাহাদুর শাহ পার্কে (ভিক্টোরিয়া পার্ক) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রেস্তোরাঁ ইজারা দিয়ে লোকজনের হাঁটাচলায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কেউ বলেছেন, কীভাবে মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়ে মাঠে সবার প্রবেশাধিকার বন্ধ করা হয়েছে।

অভিজাতপাড়ার একটি মাঠে ধনী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা উঠে এসেছে অনেকের বক্তব্যে। কেউ বলেছেন, ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্কের কথা লোকে ভুলতে বসেছে। উন্নয়নের নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্ক কয়েক বছর ধরে বন্ধ। অনেক মাঠে সাপ্তাহিক বন্ধে মেলা ও গাড়ির বাজার বসে।

জাকির হোসেন নামে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি জানান, সংসদ ভবনের সামনে প্রতিবন্ধীদের জন্য খেলার মাঠ নির্মাণের কথা ২০–২২ বছর ধরে শুধু শুনছেন।

মতবিনিময় সভায় উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে খেলার মাঠ আছে ২৩৫টি। এর মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। যেখানে এলাকাবাসীর প্রবেশাধিকার নেই। কিছু খেলার মাঠ বিভিন্ন ক্লাবের নামে দখল হয়ে আছে। সেখানে পাড়া–মহল্লার শিশু–কিশোরদের খেলার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই নেই। আবার অনেক খেলার মাঠ বিভিন্ন মেলা বা অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। যেসব এলাকায় মাঠ রয়েছে, সেগুলোও রাজনৈতিক শক্তি, জনপ্রতিনিধি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে।

গত রোববার হাইকোর্ট ঢাকা মহানগরের বিদ্যমান সব পার্ক ও খেলার মাঠের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, দ্রুত এসব স্থানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং জনসাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকারের নির্দেশ দিয়েছেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, খেলার মাঠ নিয়ে আগেও হাইকোর্টে রিট হয়েছে। নির্দেশনাও এসেছে। তবে পরে তা আবার দখলও হয়েছে। তিনি আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালে ধানমণ্ডি মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া এবং কয়েক মাস পরেই আবার দখল হওয়ার উদাহরণ টানেন।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না বলেন, এখন মাঠটিতে শিশুরা খেলতে পারছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব না নেওয়ায় শিশুরা নিজেরাই ঝাড়ু দিয়ে মাঠে খেলার ব্যবস্থা করে।

নির্ধারিত আলোচকদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক শায়ের গফুর বলেন, নগরায়ণের এই সময়ে মাঠ, পার্ক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। ভূমি ব্যবহারে নীতিনির্ধারকদের আরও সংবেদনশীল হতে হবে।

আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকায় ৮৪ শতাংশ মানুষের হাঁটা দূরত্বে মাঠ নেই। দেশের অন্যান্য জায়গারও একই অবস্থা। মাঠ উন্নয়নের নামে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ না করে স্বল্প মূল্যে মাঠ করা যায়। ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যদি পাঁচ বছর মেয়াদে একটি করেও মাঠ তৈরি করেন, তাহলে ৫ বছরে ১২৯টি মাঠ পাওয়া যাবে।

খেলার মাঠ না থাকলে শিশু–কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা ও মাদক নেওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, বলেন আইপিডির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। মাঠ না থাকলে ভূমিকম্পের সময় আশ্রয় নেওয়ার জায়গাও থাকবে না। মাঠ না থাকলে কোনো আবাসন এলাকা তৈরির অনুমোদন না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী। তিনি বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ জরুরি। শিশুর বিকাশ না হলে কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না।
সভাটি সঞ্চালনা করেন সংস্থার জ্যেষ্ঠ প্রকল্প ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান।

সভায় নগর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিকল্পনামাফিক খেলার মাঠ তৈরি, প্রতিটি ওয়ার্ডে ছেলে ও মেয়েদের জন্য ন্যূনতম একটি করে খেলার মাঠ তৈরি, স্বল্প ব্যয়ে ও সাধারণ নকশার খেলার মাঠ তৈরি, মাঠ রক্ষণাবেক্ষণে এলাকার লোকজনকে সম্পৃক্ত করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।