বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের মনজয়পাড়ার মারমা জাতিগোষ্ঠীর মেয়ে নুম্মে সাই। মেট্রোরেলে চড়ে আসন ফাঁকা পেয়েও সেখানে না বসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আগারগাঁও থেকে ট্রেন ছুটছিল উত্তরা দিয়াবাড়ির গন্তব্যে। চলন্ত ট্রেনের দরজার কাচের বাইরে নুম্মের দৃষ্টি বাইরের সারি সারি ভবনগুলোর দিকে। সুউচ্চ ভবনের ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছিল খোলা প্রান্তর আর লেক।
দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নুম্মের উত্তর, ‘সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং (ভবন) দেখছি। বিল্ডিংগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আর আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে। দাঁড়িয়ে থেকে এগুলো দেখতেই আমার খুব ভালো লাগছে।’
নুম্মে সাই পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নুম্মে থাকে তেজগাঁওয়ের সরকারি শিশু পরিবারে। কথা বলে জানা গেল, সে এর আগে কখনো কোনো ট্রেনে চড়েনি। এই প্রথম তার ট্রেনে ভ্রমণ, তা-ও আবার মেট্রোরেলে। তাঁর বড় বোন সায়ো ন্যুকে (সরকারি শিশু পরিবারেই থাকে) মিস করছে বলেও জানায় সে।
নুম্মের মতো তেজগাঁও সরকারি শিশু পরিবারের আরও ৩১ জন সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা আজ শুক্রবার মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেছে। মিরপুর-১০ সরকারি শিশু পরিবার থেকে ৩২ ছেলেশিশুও ছিল এ ভ্রমণে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী এবং জাতীয় শিশুদিবস উপলক্ষে মেট্রোরেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এমন আনন্দভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে এই শিশুদের মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশন থেকে উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি) স্টেশন ভ্রমণ করানো হয়। আবার সেখান থেকে আগারগাঁওয়ে ফিরে আসে তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথমে আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেলের কনকর্স হলের সামনে থেকে বিআরটিসির দুটি ছাদখোলা বাসে শিশুদের নিয়ে আসা হয় আগারগাঁও স্টেশনে। তখন মেয়েশিশুদের পরনে ছিল লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ আর ছেলেদের পরনে ছিল লাল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। ছেলে-মেয়ে উভয়ের জামার ওপরে ছিল আকাশি নীল রঙের টি-শার্ট আর লাল-সবুজ রঙের টুপি। আর হাতে হাতে ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা—‘শুভ জন্মদিন প্রিয় বঙ্গবন্ধু’।
পরে পৌনে ১০টার দিকে আগারগাঁও থেকে উত্তরার উদ্দেশে তাদের ট্রেন ছাড়ে। চালকের পরে কোচে (নারীদের জন্য সংরক্ষিত) শিশুরা ওঠেন। পুরো ট্রেনে যাত্রায় শিশুদের আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকতে দেখা গেছে। মেয়েশিশুরা দল বেঁধে গলা মিলিয়ে গাইছিল—‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথি মোদের ফুলপরি।’ ছেলেশিশুরা ব্যান্ডের বাদ্যবাজনা বাজিয়ে তালে তালে হাততালি দিয়ে গাইছিল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। মাঝেমধ্যে ছেলেদের কেউ আবার স্লোগানও দিচ্ছিল—‘শুভ শুভ শুভ দিন, শেখ মুজিবের জন্মদিন’।
মিরপুর-১০ সরকারি শিশু পরিবার থেকে আনন্দভ্রমণে যোগ দিয়েছে আট বছরের পারভেজ আলী। তার সঙ্গে আসা অন্যরা জানালেন, আজকের ভ্রমণে থাকা ছেলেদের মধ্যে বয়সে সে-ই সবার ছোট। পড়ছে শিশুশ্রেণিতে। তার বাড়ি ধানমন্ডির রায়েরবাজারে বলে জানাল নিজেই।
মেট্রোরেলে ভ্রমণে কেমন লাগছে, জানতে চাইলে পারভেজ জানায়, ট্রেনে চড়ে আর মজার মজার খাবার খেয়ে তার অনেক ভালো লাগছে। খাবারগুলোর নাম জানতে চাইলে সে জানায়, মিষ্টি, কেক, চকলেট, চিপস আর বরই খেয়েছে সে।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মিলি মারিয়া আক্তার আর ষষ্ঠ শ্রেণির সাকিনা আক্তার দুজনেরই এটা প্রথম ট্রেনযাত্রা। তারা পাঠ্যবইয়ে ট্রেন নিয়ে পড়েছে। কিন্তু কখনো চড়ে দেখেনি।
কেমন লাগছে, জানতে চাইলে সাকিনা আক্তারের উত্তর, ‘অনেক আনন্দ আর মজা লাগছে। সবাই আমাদের ছবি তুলছে, কথা বলছে। এতে আরও বেশি ভালো লাগছে।’
মিলি বলল, সকালে তারা যেখানে থাকে, সেখান থেকেই নাশতা করে এসেছিল। এখানে এসে মিষ্টি, চকলেট, চিপস, স্যান্ডউইচ, ম্যাংগো বার—এসব পেয়ে আরও ভালো লাগছে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এ আয়োজন নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নিলীমা আক্তার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আমাদের আজকের এই আনন্দ আয়োজন। এই শিশুদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগটি করে দিতেই এ আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় ৭০ জন শিশু আনন্দযাত্রায় শামিল হয়েছে। ঢাকার আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে শিশুরা আবার তাদের ঘরে ফিরে যাবে।’
উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছানোর পর শিশুদের মেট্রোরেলের এক্সিবিশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জন্মদিনের কেক কাটার পর আবার মেট্রোরেলে করে শিশুরা আগারগাঁওয়ে ফিরে আসে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব আবু নাছের জানান, বিআরটিসির ছাদখোলা দোতলা বাসে করে শিশুদের জাতীয় সংসদ ভবন, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা চত্বর এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভ্রমণ করানো হবে।