ডিএনসিসিতে মশা মারতে ৭ কোটি টাকায় পাঁচ ‘কামান’
ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন যন্ত্র ব্যবহারে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না। এতে জনগণের টাকার অপচয় হবে।
মশা মারতে এবার সত্যিই যেন কামান কিনছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কর্তৃপক্ষ। মশার লার্ভা নিধনে ওষুধ ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত এ যন্ত্রের একেকটির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। ইতিমধ্যে এমন ৫টি যন্ত্র কিনতে ৭ কোটি পৌনে ১৯ লাখ টাকায় একটি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের আদেশ দিয়েছে সংস্থাটি।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না। এমন যন্ত্রে জনগণের টাকার অপচয় হবে। তাই এটি কেনা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে যন্ত্রটি কেনায় কর্মকর্তাদের মত ছিল না; কিন্তু সাবেক সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের ইচ্ছায় এগুলো কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান ও সরবরাহের আদেশ দিতে হয়েছে। তবে যন্ত্রের সংখ্যা ১০টির পরিবর্তে কমিয়ে ৫টি করা গেছে।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না। এমন যন্ত্রে জনগণের টাকার অপচয় হবে। তাই এটি কেনা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
অবশ্য উত্তর সিটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, মূলত এ সিটির বর্ধিত এলাকার (নতুন যুক্ত ১৮টি ওয়ার্ড) বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে এ যন্ত্র ব্যবহার করে মশা নিধনের কাজ করা হবে। পাশাপাশি পুরোনো এলাকার যেসব জায়গায় মশকনিধনকর্মীরা ওষুধ ছিটানোর কাজে সাধারণত পৌঁছাতে পারেন না, সেসব স্থানে এ যন্ত্র দিয়ে ওষুধ ছিটানো হবে।
নতুন ধরনের যন্ত্রটি আনলে সেটি হবে লোকদেখানো। এ কেনাকাটা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, যন্ত্রটির মাধ্যমে লার্ভা নিধনের ওষুধ কুয়াশার মতো করে ছিটানো হবে। নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রায় ৩০ ফুট দূরে যন্ত্রটি দিয়ে ওষুধ ছিটানো সম্ভব হবে। তবে যন্ত্রটি বহনে প্রয়োজন হবে গাড়ির। কোনো পিকআপে তুলে বা সেটির পেছনে বেঁধে যন্ত্রটি পরিবহন করতে হবে।
এ সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, লার্ভা নিধনে সকালে দুই ধরনের ওষুধ—টেমিফস ও ম্যালেরিয়া ওয়েল-বি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বদ্ধ পানিতে লার্ভা নিধনে নোভালুরন ট্যাবলেটও ব্যবহার করে সংস্থাটি।
এ যন্ত্র কিনতে নির্দেশ ছিল সাবেক মেয়রের
উত্তর সিটির নথি অনুযায়ী, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিটি কর্মকর্তাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য সফর করেন। সফরে তিনি মশকনিধনের কার্যক্রম দেখেন। সেখানে বাফেলো টারবাইন যন্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়।
নথিতে এ–ও বলা হয়, মিয়ামি নগর কর্তৃপক্ষ তখন আতিকুল ও তাঁর কর্মকর্তাদের জানায় যে লার্ভা নিধনের ওষুধ প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান বাফেলো টারবাইনের তৈরি ‘ইউএলভি টারবাইন মিস্ট স্প্রেয়ার’ সবচেয়ে ভালো। সফর শেষে দেশে ফিরে মেয়র সেই যন্ত্র কিংবা সমপর্যায়ের যন্ত্র কেনার নির্দেশনা দেন।
এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ সংস্থাটির ভান্ডার ও ক্রয় বিভাগের কাছে ১০টি টারবাইন যন্ত্র কেনার চাহিদাপত্র পাঠায়। ভান্ডার বিভাগ প্রতিটি যন্ত্র কিনতে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করে।
দরপত্রের তিন প্রতিষ্ঠানের দুটিই একই মালিকের
বাফেলো টারবাইন কিনতে গত ২১ মার্চ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ই-জিপিতে (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে সরবরাহের কাজ পায় মোহাম্মদি হার্ডওয়্যার মার্ট।
দরপত্রের নথি যাচাইয়ে দেখা যায়, দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুটিই একই গ্রুপের (এমএইচএম গ্রুপ) মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠান দুটির দরপত্রের জামানতের টাকাও একই দিনে একই ব্যাংকের একই শাখা থেকে তিন মিনিটের ব্যবধানে জমা (পে-অর্ডার) দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় অনেক জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আবার বড় জলাশয় ও খাল রয়েছে, এমন জলাধার, যেখানে মশার প্রজনন হয়, তা নিধনেই যন্ত্রটি কেনা হচ্ছে। এটা দিয়ে বড় জায়গাজুড়ে ওষুধ ছিটানো যাবে। পরিবহনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কারিগরি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়েই কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই যন্ত্রটি কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা পরীক্ষামূলকভাবে আনা হচ্ছে। সফলতা না এলে ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হবে। দুই দফায় বাজারদর যাচাইয়ের পর দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে না জেনে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান তিনি।
‘ক্রয় বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া উচিত’
সরবরাহের আদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদি হার্ডওয়্যার মার্টের বিপণন ব্যবস্থাপক হায়দার চৌধুরীর কাছে যন্ত্রটির পরিচালনাপদ্ধতি সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ যন্ত্রের মাধ্যমে ওষুধ বাতাসে ছিটানো হবে। ওষুধ মশার গায়ে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে। যন্ত্রটি পিকআপে উঠিয়ে বা আলাদা গাড়িতে টেনে বহন করতে হবে।
যন্ত্রটি কেনার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবেক মেয়র (আতিকুল ইসলাম) একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি স্পষ্ট ‘না’ করেছিলাম। বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এত টাকা দিয়ে যন্ত্রটি কেনার যৌক্তিকতা নেই। এতে অর্থের অপচয় হবে।’
কবিরুল বাশার আরও বলেন, এ ধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে একই কাজ করা যাবে, তা অনেক কম দামে বাজারে পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে ওই যন্ত্রের চেয়েও এটি মশকনিধনে ভালো কাজ করবে। নতুন ধরনের যন্ত্রটি আনলে সেটি হবে লোকদেখানো; কিন্তু মশানিয়ন্ত্রণে অনেক বেশি কাজে দেবে না। এ কেনাকাটা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।