‘দাম চাইতেই আসছি, আপনি বুদ্ধি খাটায় বলেন’
শেষ মুহূর্তে কোরবানির পশু কিনতে হাটে ছুটছেন ক্রেতারা। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে গাবতলীর হাটে চলছে শেষ সময়ের কেনাবেচা। তবে রাজধানীর স্থায়ী-অস্থায়ী হাট ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার অলিগলির সামনে কোরবানির পশু নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। রাজধানীর আশপাশের জেলা গাজীপুর, নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা এই বিক্রেতাদের অধিকাংশ এনেছেন ১০ থেকে ১৫টি করে বকরি ও খাসি, যা কিনতে ক্রেতার হাসিল লাগছে না। আবার ঘরের কাছেই হওয়ায় প্রয়োজন হচ্ছে না গাড়ি ভাড়া করার।
দাম চাইছেন খুশিমতো, তবে দামাদামি করার সুযোগ ভালোই আছে। কাকরাইল মোড়ে লিটন মিয়া এসেছেন নরসিংদী থেকে আজ সকাল আটটার দিকে আটটি পশু নিয়ে। সকাল ১০টার মধ্যে তাঁর ২টি পশু বিক্রি হয়েছে। তাঁর ধারণা, বিকেলের মধ্যে বাকি পশুগুলো বিক্রি হয়ে যাবে। লিটন মিয়ার একেকটি ছাগল ১২ থেকে ১৫ কেজি করে মাংস হবে। দাম চাইছেন ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তবে দামের দিক দিয়ে একেবারে আক্কেলগুড়ুম অবস্থা কুষ্টিয়ার আবু সালেহর কথা শুনে। তিনি ৩০টি খাসি নিয়ে এসেছেন। একজনকে দিয়ে হাটে পাঠিয়েছেন ২০টি। আর নিজে মালিবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ১০টি নিয়ে। এখানে মানুষের ভিড় বেশি। আশপাশের অনেক ক্রেতাই হাটে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়েছেন এখানে। আবু সালেহ একটু বেশি বুদ্ধিমান। ২০ থেকে ২৫ কেজি মাংস হতে পারে—এমন একেকটি খাসির দাম চাইছেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে। দু-একজন ক্রেতা তাঁর উচ্চ মূল্য শুনে ফিরে যেতে চাইছিলেন। আবু সালেহ অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন, ‘দূর থিকা আপনাদের বাড়ির কাছে পর্যন্ত নিয়া আসছি, হাসিল দেওয়ার ঝামেলা নাই। গাড়িভাড়া লাগবে না, বুঝে দেখেন।’ তাতে বিশেষ সুবিধা হলো না। কারণ, একটু দূরেই ১২টি খাসির দড়ি ধরে বসে থাকা গাজীপুরের শ্রীপুরের এনামুল হকের পশুগুলোও ওজন-উচ্চতায় খারাপ নয়, কিন্তু দাম চাইছেন ওজন-আকার বুঝে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। এর মধ্যে বেলা ১১টার দিকে দুটি বিক্রি করেছেন ১৭ হাজার টাকা করে।
এই বিক্রেতারা তাঁদের স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন গৃহস্থের কাছ থেকে এই খাসি কিনেছেন। এরপর কয়েকজন মিলে পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে আজ রাজধানীতে এসেছেন বিক্রি করতে। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, যেহেতু গ্রামের গৃহস্থদের কাছ থেকে কেনা, এ কারণে অধিকাংশই দেশি জাতের।
মালিবাগ মোড় থেকে এগিয়ে শান্তিবাগের ভেতর দিকে মসজিদের কাছে ১৫টি খাসি নিয়ে বসে ছিলেন নরসিংদীর বাশার মিয়া। তিনি মাঝারি আকৃতির একটি খাসির দাম ৬০ হাজার টাকা চাইতেই এক ক্রেতা কিছুটা ভেংচি কাটলেন দাম শুনে। বাশার মিয়া অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে হাসিমুখে বললেন, ‘এত দূর থিকা দাম চাইতেই আসছি, আপনি বুদ্ধি খাটায়ে একটা বলেন। এত রাগ করেন কেন?’ ক্রেতার রাগ মনে হয় তাতে আরও একটু বেড়ে গেল। তিনি ‘ধুর মিয়া’ বলে সরে গেলেন নিজের গন্তব্যে। তবে এখানকার বাসিন্দা কামাল হোসেন জানালেন, তিনি এ বছর দ্বিধায় ছিলেন কোরবানি দিতে পারবেন কি না। প্রতিবছরই তিনি ভাগে গরু কোরবানি দেন, তবে এ বছর একটু আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন বলে দ্বিধায় ছিলেন। শেষ মুহূর্তে সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকার মধ্যে একটা খাসি কিনবেন। তাই বের হয়েছেন। এখন হাট পর্যন্ত যাবেন, না গলি থেকেই নেবেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এই বিক্রেতাদের মধ্যে পলাশীর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাজিপুরের শাহ আলীর ভাগ্য মনে হয় সবচেয়ে ভালো। তিনি ১০টি খাসি এনেছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে তাঁর ৫টি পশু বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে তিনি খুশি। তিনি খুব বেশি দামও চাননি। বললেন, সব কটি বিক্রি হয়ে যাবে বিকেলের আগেই। এরপর বাড়ি চলে যাবেন। শাহ আলী জানান, তিনি প্রতিবছরই কোরবানির ঈদের আগের দিন এভাবে আসেন। একসময় পলাশীতে হাট বসত। তখন সেই হাটে বসতেন।
হাতিরপুল বাজারে সিগন্যালের একটু দূরেই বসে ছিলেন ফিরোজ মিয়া। এ জায়গাটা রমরমা। তিনি জানান, বাজারের কাছে বসার সুবিধা হচ্ছে ক্রেতা বেশি থাকে গলির চেয়ে। আর কোরবানির পশু সারা দিন রাখার জন্য ওদের দানাপানি খাওয়ানোর ব্যবস্থারও দরকার আছে। ফিরোজ মিয়ার আনা কোরবানির পশুগুলোকে দেখা গেল কাঁঠালপাতা খাচ্ছে এবং রাস্তার গাড়ি ও লোকজন দেখছে। হাতিরপুল বাজারের কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কোরবানির পশু আগেই কিনেছেন। কেউ দিচ্ছেন ভাগে কোরবানি। আজ এসেছেন ঈদের রান্নার বাজার করতে। তবু কোরবানির প্রাণী দেখলে একটু দামদর করতে ইচ্ছা করে বলেই খোঁজ নিচ্ছেন।