রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠ। আজ শুক্রবার বেলা ২টার দিকে সেখানে পৌঁছায় একটি অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে শিক্ষার্থীদের প্রিয় ‘লাকি টিচার’ ও তাঁর মেয়ের মরদেহ। অ্যাম্বুলেন্স দেখেই শুরু হয় কান্নার রোল। পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় দুজনের।
‘লাকি টিচার’ ছিলেন বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (স্কুল শাখা) ব্যবসায়িক শিক্ষার শিক্ষক। তাঁর পুরো নাম লুৎফুন নাহার করিম (লাকি)। মেয়ে জান্নাতিন তাজরীও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুনে মৃত্যু হয়েছে দুজনের।
মা লুৎফুন নাহার করিম ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বোন জান্নাতিন তাজরীর সঙ্গে গতকাল কাচ্চি ভাইতে খেতে যাওয়ার কথা ছিল সাদমান সাকিবেরও।
শুধু এ দুজনই নন। গতকালের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে ভিকারুননিসার বর্তমান ও প্রাক্তন আরও তিন শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে রয়েছে স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন। তার বোন ও ভিকারুননিসার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফওজিয়া আফরিন। আরেকজন হলেন লামিসা ইসলাম। তিনিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগে।
আজ ভিকারুননিসার মাঠে শিক্ষক লুৎফুন নাহার করিম ও তাঁর মেয়ে জান্নাতিন তাজরীর মরদেহ আনার পর শোকাবহ এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা একে–অপরের কাঁধে মাথা রেখে বা একলা দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিল। শিক্ষক ও অভিভাবকেরাও ঘটনাটি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। মাঠে দুজনের মরদেহ আনা হলেও জানাজার আগে গতকাল মারা যাওয়া বাকি তিনজনের জন্যও দোয়ার আহ্বান জানানো হয়।
জানাজা শুরুর আগে কথা হয় শিক্ষকদের সঙ্গে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মুশতারী সুলতানা শিক্ষকদের কক্ষে একটি চেয়ার দেখিয়ে বলেন, ‘এখানেই লাকি আপা বসতেন। বৃহস্পতিবারও তাঁদের সবার প্রিয় লাকি টিচার স্কুলে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষক রুমে সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছেন। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই তিনি স্মৃতি হয়ে গেছেন।’
গতকালের মৃত্যুর ঘটনায় আগামী রোববার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের সাততলা ভবনটিতে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে আজ দুপুর পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ৪৬ জন হয়েছে। ১২ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁরা শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। ভবন থেকে ৭০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
‘আম্মুর মোবাইলে কল দিচ্ছিলাম বারবার’
আগুন লাগা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান রয়েছে। ওপরের তলাগুলোয় রয়েছে আরও খাবারের দোকান। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের এসব দোকানে ক্রেতাদের ভিড় থাকে। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান। ভিকারুননিসার শিক্ষক লুৎফুন নাহার করিমও তাঁর মেয়েকে নিয়ে সেখানে খেতে গিয়েছিলেন।
মা লুৎফুন নাহার করিম ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বোন জান্নাতিন তাজরীর সঙ্গে গতকাল কাচ্চি ভাইতে খেতে যাওয়ার কথা ছিল সাদমান সাকিবেরও। তবে ভেতরে ঢোকেননি তিনি। বাইরে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ভবনের ভেতরে ছিলেন মা ও বোন।
এ ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ শোকাহত। আর এ ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খতিয়ে দেখছেআ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সংসদ সদস্য
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে মা ও বোনের জানাজার সময় সাদমানকে ধরে রেখেছিলেন তাঁর বন্ধুরা। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভর্তি পরীক্ষা ছিল। তবে তিনি অংশ নিতে পারেননি। এক ফাঁকে কথা বলার সুযোগ হয় সাকিবের সঙ্গে। জানান, অপেক্ষা করতে করতেই চোখের সামনে আগুন আর ধোঁয়া দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘আম্মুর মোবাইলে কল দিচ্ছিলাম বারবার।’
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, এ ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ শোকাহত। আর এই ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খতিয়ে দেখছে। এ সময় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, যাঁরা মারা গেছেন তাঁরা আর ফিরবেন না। তবে এ ঘটনা থেকে অন্যদের শিক্ষা নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে।
ভিকারুননিসা নূন পরিবারের এই পাঁচ সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী, ধানমন্ডি প্রভাতি শাখার শাখাপ্রধান মাহমুদ আহমদসহ বিভিন্ন শাখার শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আনোয়ার কবির ভূইয়াসহ অন্যরাও জানাজায় অংশ নেন।
গতকালের মৃত্যুর ঘটনায় আগামী রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পরদিন সোমবার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শাখায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ ও দোয়া পাঠ করবেন।
আজ জানাজা শেষে লুৎফুন নাহার ও তাঁর মেয়ের মরদেহ দেখার সুযোগ দেওয়া হয় নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। মরদেহ দেখে ফেরার পর কয়েকজন শিক্ষক বলছিলেন, মনে হচ্ছে লাকি আপা ঘুমিয়ে আছেন। একটু কালচে দাগ ছাড়া মুখটা প্রায় একই আছে।