বড় প্রকল্প উদ্বোধন করে ভোটের যাত্রায় আওয়ামী লীগ
বিএনপি অক্টোবরে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে চায়। সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনে বড় জমায়েত করে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়।
বড় বড় প্রকল্প উদ্বোধন করে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। চলতি অক্টোবর মাসজুড়ে বড় প্রকল্প ও গুচ্ছ উন্নয়নকাজ মিলিয়ে সাতটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। প্রায় প্রতিটি প্রকল্প উদ্বোধনের দিন সুধী সমাবেশ হবে। সমাবেশগুলোতে বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করবে ক্ষমতাসীন দলটি।
শুরুটা হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। শেষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হতে পারে ২৮ অক্টোবর। ওই দিন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর চট্টগ্রামে বড় সুধী সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ।
মাঝে ঢাকায় মেট্রোরেলের মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল শুরু, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন এবং ১৪০টি সেতু, ১২টি ওভারপাস ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভিআইসি) উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। উদ্বোধন হতে পারে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচলেরও।
এসব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এগিয়ে আসবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের তফসিলের পর উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা যায় না। কারণ, তা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়। উল্লেখ্য, ভোট হতে পারে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, অক্টোবরজুড়ে এভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও সমাবেশ করার পেছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, দেশে নির্বাচনী আবহ তৈরি করা। বড় প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিগত ১৫ বছরে সরকারের অর্জন তুলে ধরবেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চাইবেন।
দ্বিতীয়ত, অক্টোবর মাসে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চাইবে। এ সময়ে আওয়ামী লীগ উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করে মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস তৈরি করতে চায়। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচির পাল্টাও রাখবে তারা।
বিএনপি অবশ্য সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন কৌশল নিয়ে ভাবছে না। তারা অক্টোবর মাসেই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন জোরদার করতে চায়। আজ বুধবার তাদের রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এরপর দলটি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। সেই কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক।
আওয়ামী লীগের কৌশলের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে মাঠ দখল-বেদখলের বিষয় নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক উপায়ে কর্মসূচি দিতেই পারে। তাদের সেই কর্মসূচি নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।’ তিনি বলেন, ‘তারা (সরকার) আমাদের কর্মসূচির কাউন্টার (পাল্টা) কর্মসূচি দেয়, পুলিশ দিয়ে বাধা দেয়, আক্রমণ করে—সমস্যা তো এখানেই।’
ইউরেনিয়াম হস্তান্তর ৫ অক্টোবর
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি বা ইউরেনিয়াম গত সপ্তাহে বিশেষ উড়োজাহাজে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার হবে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর অনুষ্ঠান। এতে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের।
দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। মোট ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে আগামী বছর জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায় রূপপুর কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দরে টার্মিনাল উদ্বোধন ৭ অক্টোবর
৭ অক্টোবর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন উত্তরার দিয়াবাড়িতে সুধী সমাবেশে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এই টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ব্যয় সরকার বহন করছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ চালু ১০ অক্টোবর
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন হবে ১০ অক্টোবর। এটি সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। এর আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেলপথ চালু হচ্ছে। আগামী বছরের জুনে যশোর পর্যন্ত রেল চালুর লক্ষ্য ঠিক করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১০ অক্টোবর কমলাপুর থেকে একটি ট্রেন ছেড়ে যাবে। পদ্মা সেতুর আগে মাওয়া স্টেশনে হবে সুধী সমাবেশ। সেখানেই উদ্বোধনের কার্যক্রম হবে। এরপর ট্রেনে উঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাঙ্গায় যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক সমাবেশ হতে পারে।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৩ মে অনুমোদন করা হয়। সে সময় এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
এই রেলপথ নির্মাণের কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
রেলের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালুর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নতুন রেলপথও চালুর অবস্থায় আছে। প্রধানমন্ত্রীর সময় পেলেই উদ্বোধনের সময়সূচি ঘোষণা করা হবে।
মেট্রোরেল মতিঝিল যাবে ২৩ অক্টোবর
মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ চালু হবে ২৩ অক্টোবর। এদিন মতিঝিলে সুধী সমাবেশে আওয়ামী লীগ ঢাকা বিভাগের সব জেলা থেকে লোক এনে বড় জমায়েত করবে। সমাবেশ সফল করতে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে আওয়ামী লীগ।
মেট্রোরেলের এই অংশ ২০ অক্টোবর উদ্বোধন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত রোববার আওয়ামী লীগের এক কর্মসূচিতে তিনি জানান, ২৩ অক্টোবর মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর চালু হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। শুরুতে অবশ্য মেট্রোরেল ছিল মতিঝিল পর্যন্ত। পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হতে ২০২৫ সাল লেগে যেতে পারে।
টানেল উদ্বোধন ২৮ অক্টোবর
২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের যানবাহন চলাচল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন চট্টগ্রামে সুধী সমাবেশে বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করতে তৎপর কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে তা বেড়ে হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকারের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশে টানেল চালু হচ্ছে। এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।
এর বাইরে ২২ অক্টোবর তেজগাঁওয়ে সড়ক ভবনে ১৪০টি সেতু, ১২টি ওভারপাস ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভিআইসি) উদ্বোধন করা হবে। ওই দিন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের চেক দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
‘ভোটার আকৃষ্ট করা স্বাভাবিক ব্যাপার’
বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে মানুষের ভোট দিতে না পারা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনৈতিক অবস্থা, বৈশ্বিক চাপ ইত্যাদি বিষয় সামনে আনতে পারে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নকে সামনে রেখে প্রচার চালাবে।
অক্টোবরজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও সমাবেশ আয়োজনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উন্নয়ন, অর্জন—এটা তো জনগণ উদ্যাপন করবেই। ভোট চলে এসেছে। ফলে ভোটারকে আকৃষ্ট করা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আওয়ামী লীগ সেই কাজই করছে।
অবশ্য সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের জাঁকজমক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনমুখী আবহ তৈরি করতে চাইলেও বিরোধী দল এক দফা দাবিতে এখনো অনড় আছে। তারা রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ফয়সালা করতে চায়। এই অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।