ঢাকা-১৪ আসনে যেখানে খুশি সেখানেই কার্যালয়
আচরণবিধি ভঙ্গ করে তিনটি ওয়ার্ডে ২২টি নির্বাচনী ক্যাম্প। বেশির ভাগই সড়ক ও ফুটপাত দখল করে স্থাপন করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটির বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই—আচরণবিধিতে এমনটিই বলা আছে। তবে ঢাকা-১৪ আসনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডেই (রূপনগর এলাকা) আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প (অস্থায়ী কার্যালয়) রয়েছে অন্তত ১০টি। শুধু এই ওয়ার্ডই নয়, ঢাকা-১৪ সংসদীয় আসনের আরও দুটি ওয়ার্ডে (৮ ও ৯ নম্বর) আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ১২টি নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে।
তিনটি ওয়ার্ডের ২২টি নির্বাচনী ক্যাম্পের মধ্যে বেশির ভাগই সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বানানো হয়েছে। এটিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য করা আচরণবিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-১৪ আসনের তিনটি ওয়ার্ডের (৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কে আচরণবিধি ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে একাধিক তোরণও তৈরি করা হয়েছে।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাইনুল হোসেন খান (নিখিল)। তিনি আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ছয়টি ওয়ার্ড (৭-১২) এবং সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়ন মিলে ঢাকা-১৪ আসন। এবার এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১৪ জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছয়জন, যা ঢাকার (মহানগর, জেলাসহ) ২০টি আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ।
৭ নম্বর ওয়ার্ডে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় রূপনগর শাখা রয়েছে। এই বিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে, রূপনগর ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে, সরকারি রূপনগর মডেল স্কুলের গলির মুখে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে আরেকটি কার্যালয় করা হয়েছে।
এক ওয়ার্ডেই ১০ নির্বাচনী ক্যাম্প
রূপনগর আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কে নির্মাণাধীন সিটি সেন্টারের ভবনের নিচতলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়। এটিসহ ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার প্রার্থীর আরও অন্তত ৯টি নির্বাচনী কার্যালয় রয়েছে। এই ওয়ার্ডের ঝিলপাড় বস্তির সামনে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে আরেকটি কার্যালয় করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ, কাঠ ও শামিয়ানা দিয়ে বানানো এই কার্যালয়ের ভেতরে কয়েকটি চেয়ার পাতা। তবে কোনো নেতা-কর্মী নেই। এই কার্যালয়ের কয়েক মিটার সামনে শিয়ালবাড়ি মোড়ে ফুটপাতের ওপরে আরেকটি কার্যালয় করা হয়েছে।
৭ নম্বর ওয়ার্ডে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় রূপনগর শাখা রয়েছে। এই বিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে, রূপনগর ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে, সরকারি রূপনগর মডেল স্কুলের গলির মুখে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে আরেকটি কার্যালয় করা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ডের রজনীগন্ধা মার্কেটের পাশের ফুটপাতে এবং রূপনগর ১০ নম্বর রোডের প্রবেশমুখে সড়কের অর্ধেক অংশ দখল করে আরেকটি কার্যালয় করা হয়েছে।
৯ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে গাবতলী এলাকায়। এখানে নৌকার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় বাগবাড়ী কারমাইকেল রোডের বিউটি কমিউনিটি সেন্টারের নিচতলায়। এটি ছাড়াও বেড়িবাঁধের বেষ্টনী প্রকল্প মার্কেটের সামনে এবং বেড়িবাঁধের দুই পাশে আরও চারটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে।
এই আটটি কার্যালয়ের বাইরে গতকাল সরেজমিন আরও দুটি নির্বাচনী কার্যালয় দেখা গেছে। রূপনগর ১২ নম্বর সড়কের সোনার বাংলা মার্কেটের সামনে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে পাশাপাশি দুটি নির্বাচনী কার্যালয় করা হয়েছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার সব কটি নির্বাচনী কার্যালয়ই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে বানানো হয়েছে।
৭ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল হাই হারুন। এক ওয়ার্ডে এতগুলো কার্যালয় স্থাপন করার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের একটাই প্রধান কার্যালয়। অন্য কাউকে নির্বাচনী ক্যাম্প করতে বলিনি। অতি উৎসাহী লোকজন, যারা নিখিল সাহেবের ভক্ত, তারা বানিয়েছে। তারাই সেগুলোতে বসে।’
সব মিলিয়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী ক্যাম্প সাতটি। এর ছয়টিই সড়ক ও ফুটপাতের জায়গা দখল করে করা হয়েছে।
৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ১২টি ক্যাম্প
৮ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ এলাকা মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের আওতাধীন। এখানে নৌকার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় চিড়িয়াখানা রোডের ঈদগাহ মাঠের সামনে। এই ওয়ার্ডের সনি সিনেমার উল্টো পাশে, গুদারাঘাট, বক্সনগর মোড়, বিআইএসএফের ভবনের উল্টো পাশে, বিসিআইসি কলেজের ফটকের পাশে এবং মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে আরও ছয়টি নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে।
সব মিলিয়ে এই ওয়ার্ডে নির্বাচনী ক্যাম্প সাতটি। এর ছয়টিই সড়ক ও ফুটপাতের জায়গা দখল করে করা হয়েছে।
৯ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে গাবতলী এলাকায়। এখানে নৌকার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় বাগবাড়ী কারমাইকেল রোডের বিউটি কমিউনিটি সেন্টারের নিচতলায়। এটি ছাড়াও বেড়িবাঁধের বেষ্টনী প্রকল্প মার্কেটের সামনে এবং বেড়িবাঁধের দুই পাশে আরও চারটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে। এর মধ্যে বেড়িবাঁধের পাশে বাঁশ, কাঠ ও শামিয়ানায় ঘেরাও দেওয়া একটি ক্যাম্পের আকার এক হাজার বর্গফুটের মতো। যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী, ৪০০ বর্গফুটের বেশি আকারের কোনো নির্বাচনী ক্যাম্প করা যায় না।
আচরণবিধিতে বলা আছে, নির্বাচনী প্রচারে কোনো ধরনের গেট বা তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। তবে ঢাকা-১৪ আসনের মাজার রোডের প্রবেশমুখে, গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের প্রবেশমুখে, চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ের সামনে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।
ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী
ঢাকার সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে ঢাকা-১৪ আসনেই প্রার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নৌকার মাইনুল হোসেন ছাড়া অন্য প্রার্থীরা হলেন জাতীয় পার্টির আলমাস উদ্দিন (লাঙ্গল), জাসদের আবু হানিফ (মশাল), তৃণমূল বিএনপির নাজমুল ইসলাম (সোনালী আঁশ), বিএনএফের কামরুল ইসলাম (টেলিভিশন), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মাহবুব মোড়ল (আম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ (একতারা), সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আসিফ হোসেন (ছড়ি), স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আক্তার (ট্রাক), লুৎফর রহমান (কেটলি), জেড আই রাসেল (ঈগল), এমরুল কায়েস খান (রকেট), মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ (দালান) ও কাজী ফরিদুল হক (বাঁশি)।
গতকাল নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নৌকার পাশাপাশি ট্রাক প্রতীকের পোস্টার-ব্যানারের উপস্থিতিও রয়েছে। এ ছাড়া কেটলি, লাঙ্গল ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর পোস্টারও চোখে পড়েছে। রকেট, সোনালী আঁশ ও বাঁশি প্রতীকের পোস্টারও কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এবং অনুসন্ধান কমিটি আচরণবিধির বিষয়গুলো দেখছে।ঢাকা-১৪ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আবেদ আলী
ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি সাবিনা আক্তার। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ ও যুব মহিলা লীগের সমর্থন পাচ্ছেন সাবিনা। এই আসনে ১৪ জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের মাইনুল হোসেনের সঙ্গে যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রী সাবিনার মূল লড়াই হবে বলে স্থানীয় জনগণ মনে করছেন।
১৮ ডিসেম্বর ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর দিনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। অনুমতি না নিয়ে নির্বাচনী সমাবেশ করায় এবং নির্ধারিত মাপের চেয়ে বড় আকৃতির রঙিন ব্যানার টানানোয় ২০ ডিসেম্বর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।
নৌকার প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ঢাকা-১৪ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আবেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এবং অনুসন্ধান কমিটি আচরণবিধির বিষয়গুলো দেখছে। আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিতে বলবেন বলে জানান তিনি।