শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্ক: দখলদারকেই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিল ডিএনসিসি
৮ দশমিক ৮৭ একর আয়তনের পার্কটির অবস্থান গুলশান ২ নম্বরের ১৩০-এ প্লটে। আগে নাম ছিল গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক।
রাজধানীর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কের ব্যবস্থাপনা-রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গুলশান ইয়ুথ ক্লাবকে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। পার্কটির একটি বড় অংশ আগে থেকেই ক্লাবটির দখলে। এখন পুরো পার্কের নিয়ন্ত্রণ ক্লাবটির হাতে চলে গেল।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) গুলশান মডেল টাউনের নকশা অনুযায়ী, ৮ দশমিক ৮৭ একর আয়তনের পার্কটির অবস্থান গুলশান ২ নম্বরের ১৩০-এ প্লটে। আগে নাম ছিল গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নতুন নামকরণ হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্ক।
পার্কের ৫ দশমিক ৫৪ একর জায়গা অনেক দিন ধরে ইয়ুথ ক্লাবের দখলে। উন্নয়ন-সংস্কারের পর পার্কের বাকি ৩ দশমিক ৩৩ একর অংশ দেড় বছর আগে উদ্বোধনের পর উন্মুক্ত করে দেয় ডিএনসিসি।
পুরো পার্কের ব্যবস্থাপনা-রক্ষণাবেক্ষণে চলতি বছরের শুরুতে ডিএনসিসি ও ইয়ুথ ক্লাবের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ইয়ুথ ক্লাব এই তথ্য জানিয়ে বলছে, চুক্তিটি হয়েছে তিন বছরের জন্য।
চুক্তিতে কী আছে, তা জানতে চেয়ে ডিএনসিসি বা ইয়ুথ ক্লাব—কোনো পক্ষের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজউক বলছে, তারা পার্কটি ডিএনসিসির কাছে হস্তান্তর করেছিল। এ নিয়ে রাজউকের সঙ্গে ডিএনসিসির চুক্তি হয়েছিল। পার্কটির দায়িত্ব তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে ডিএনসিসি।
ইয়ুথ ক্লাব চুক্তির পর পার্কের ঘাসে আচ্ছাদিত খোলা জায়গা নষ্ট করে সেখানে ফুটবল খেলার জন্য একটি কৃত্রিম মাঠ (আর্টিফিশিয়াল টার্ফ) তৈরি করছে। এ কাজের উদ্বোধন করেছেন স্বয়ং ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
পার্কের দখল-ধ্বংস বন্ধের দাবিতে গত মে মাসের শুরুর দিকে একটি প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়। পার্ক এলাকায় আয়োজিত এ কর্মসূচিতে স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, ইয়ুথ ক্লাব পার্কটি নিজেদের দখলে নিয়ে বেআইনিভাবে অবকাঠামো বানাচ্ছে। পার্কটি ধ্বংস করে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর করছে।
পার্কটি দখল হচ্ছে না বলে দাবি করেন মেয়র আতিকুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। প্রক্রিয়া অনুযায়ী, ইয়ুথ ক্লাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, যৌথ ব্যবস্থাপনায় পার্ক পরিচালনার জন্য তাঁরা ডিএনসিসিকে একটা নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছিলেন। এ নীতিমালায় ডিএনসিসি মেয়র সম্মতি জানিয়েছিলেন। ঘটনা এমন হলে (ইয়ুথ ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি) তা হবে মেয়রের নিজের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কাজ।
হাইকোর্টের রায়
প্লটটিতে (পার্কের জায়গা) অনুপ্রবেশকারী ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রাজউক একটি নোটিশ দিয়েছিল। নোটিশের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট করে ইয়ুথ ক্লাব। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট রায় দেন আদালত।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, পার্কের জায়গা দখলের কোনো আইনগত অধিকার ইয়ুথ ক্লাবের নেই। প্লটটি গুলশান মডেল টাউনের লে-আউট নকশা অনুযায়ী পার্কের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত। এটি পার্ক হিসেবে থাকবে। কোনো অবস্থাতেই প্লটে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। পার্ক ছাড়া অন্য কোনো কাজে প্লট ব্যবহার করা যাবে না। পার্কটি পুনরুদ্ধার করতে নির্দেশ দেন আদালত। পার্ক রক্ষায় প্লটে থাকা সব অনুমোদনহীন কাঠামো ভেঙে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে ইয়ুথ ক্লাব।
উন্নয়নে ‘বাধা’
পুরো পার্কের উন্নয়নে একটি নকশা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ। নকশাটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হয় ২০২১ সালের ৩০ মার্চ।
তবে ঠিকাদারের মাধ্যমে পার্ক উন্নয়ন-সংস্কারের কাজ হয় মাত্র ৩ দশমিক ৩৩ একর জায়গায়। বাকি জায়গা ইয়ুথ ক্লাবের দখলে থাকায় সে অংশে কোনো উন্নয়নকাজ করতে পারেনি ডিএনসিসি।
ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন ইয়ুথ ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে চাপ আসতে থাকে। তাই ক্লাবের দখলকৃত অংশ বাদ দিয়ে পার্কের উন্নয়নকাজ করা হয়।
২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর উন্নয়নকৃত ৩ দশমিক ৩৩ একর জায়গার পার্কটির উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। তখনই পার্কের নতুন নামকরণ করা হয়।
ক্লাবের কাছে পার্ক হস্তান্তর
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, নিজেদের মালিকানাধীন পাঁচটি পার্ক ও মাঠের পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনার জন্য আগ্রহপত্র (ইওআই) চেয়ে গত বছরের ২৫ জানুয়ারি একটি বিজ্ঞপ্তি দেয় সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ। এর মধ্যে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কটি ছিল।
বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের আগ্রহপত্র মূল্যায়নে গত বছরের মে মাসে একটি সভা করে ডিএনসিসির কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি। মূল্যায়নে বেশি নম্বর পাওয়ায় পার্কটি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনার জন্য ইয়ুথ ক্লাবের নাম সুপারিশ করে কমিটি।
গত ১৭ জানুয়ারি ডিএনসিসির দ্বিতীয় পরিষদের ২৫তম বোর্ড সভায় পার্কের জন্য ইয়ুথ ক্লাবকে ‘অপারেটর’ নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয় বলে জানা যায়।
কৃত্রিম টার্ফ তৈরি
ইয়ুথ ক্লাব দায়িত্ব পাওয়ার পরই পার্কে ফুটবল খেলার কৃত্রিম একটি মাঠ (আর্টিফিশিয়াল টার্ফ) তৈরি শুরু করে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি টার্ফ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন মেয়র আতিকুল।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, টার্ফের কারণে পার্কের সবুজ ঘাস-আচ্ছাদিত খোলা জায়গা নষ্ট হয়েছে। নির্মাণাধীন টার্ফের মাঠ লোহার জালের বেড়া দিয়ে ঘিরে ‘সংরক্ষিত’ করা হয়েছে।
কৃত্রিম টার্ফ নির্মাণের সিদ্ধান্তের আগে পার্কের নকশা প্রণয়নকারীদের জিজ্ঞাসা করা বা পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাকিউল ইসলাম। তিনি বলেন, নকশায় পাকা অংশ (কংক্রিট) কমানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন সবুজ ঘাস ধ্বংস করে নকশার উল্টো কাজ হচ্ছে। নগরবাসীকে প্রকৃতির কাছে নেওয়ার যে চেষ্টা ছিল, সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ, সবুজ ঘাস নষ্ট করে স্থাপনা করা হচ্ছে। এমন টার্ফ বহুতল ভবনের ছাদেও করা যায়। কিন্তু সবুজ ঘাসে আবৃত ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে না। ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর পার্কে শিশুদের আনাগোনা আগের চেয়ে কমে গেছে।
ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহে আলম বলেন, ইয়ুথ ক্লাব মামলায় হেরে গেছে। তাই এখন পুরো জায়গার মালিকানা ডিএনসিসির। ইয়ুথ ক্লাবকে শুধু ব্যবস্থাপনা-রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের সঙ্গে করা চুক্তির মধ্যে কৃত্রিম টার্ফ নির্মাণের বিষয়টি আছে। চুক্তির মেয়াদ শেষে টার্ফটি ডিএনসিসির হবে।
বেশির ভাগ জায়গা ‘সংরক্ষিত’
ডিএনসিসির কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পরও পার্কের উন্নয়ন করা জায়গা (৩ দশমিক ৩৩ একর) বাদে আগের সবকিছুই ইয়ুথ ক্লাব ‘সংরক্ষিত’ করে রেখেছে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ইয়ুথ ক্লাবের দখল অংশের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে থাকা হাঁটার রাস্তাটি শুধু সর্বসাধারণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। বাকি সবকিছুই ক্লাবের সদস্যসহ তাঁদের আওতাধীন বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা।
দখল অংশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে বড় একটি মাঠ। ক্লাব এই মাঠকে মূলত ক্রিকেট খেলার জন্য ব্যবহার করে। এ মাঠে ফুটবলও খেলা হয়। পুরো মাঠ লোহার তৈরি জাল দিয়ে ঘেরা। ক্লাবের একাডেমির শিক্ষার্থীরা এ মাঠে ক্রিকেট খেলেন, প্রশিক্ষণ নেন। এটি ভাড়া দেওয়া হয় বলেও সূত্র জানায়।
বড় মাঠের পূর্ব পাশে টেনিস কোর্ট, ইনডোর ব্যাডমিন্টন কোর্ট, বাস্কেটবল মাঠ, জিমনেশিয়াম, স্কেটিং জোন, লেডিস কর্নার, অ্যাডভেঞ্চার হাট (খোলা জায়গা) রয়েছে। শেষের তিনটি বাদে প্রতিটিই সংরক্ষিত। মাঠের পাশে টিনের ছাউনির খোলা একটি ঘরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হয়।
বড় মাঠটি (ক্রিকেট) সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে সময় নির্ধারণের কাজ চলছে বলে জানান ক্লাবটির ম্যানেজার (অপারেশন) পরিচয় দেওয়া মিতু নামের এক ব্যক্তি। এ ছাড়া এখানে টেনিস, বাস্কেটবল বা ব্যাডমিন্টন খেলতে, প্রশিক্ষণ নিতে লোকজনকে নামমাত্র পরিমাণ টাকা দিতে হয় বলে জানান তিনি।
পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চলতি বছরের শুরুতে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ দিয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান ইয়ুথ ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান।
আদালতের রায় অনুযায়ী পার্কের জায়গা দখলের বৈধতা না থাকার বিষয়ে ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ক্লাবের কারণেই এখন সেখানে খোলা জায়গা, খেলার জায়গা আছে। তা না হলে ওই জায়গাও প্লট করে বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হতো। ডিএনসিসির অনুমতি নিয়েই সেখানে ফুটবল খেলার টার্ফ করা হচ্ছে। এতে জায়গাটিতে ১২ মাসই সবুজ ঘাস থাকবে।
‘রাজউকের লোকের রাগের জের’
হাইকোর্টের রায়ের পরও ইয়ুথ ক্লাবকে পার্ক পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের দুজন লোক সেখানে (পার্ক) হাঁটতে গিয়েছিলেন। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের খাতায় স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল। তাঁরা খাতায় স্বাক্ষর করেননি। তার পর থেকেই তাঁদের রাগ। এ কারণেই এসব প্রসঙ্গ এখন সামনে আনা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
অবৈধ স্থাপনা ভাঙার বিষয়ে মেয়র আতিকুল বলেন, ‘ইয়ুথ ক্লাবের যেগুলো আছে, সেখানে খেলাধুলা হয়, এটা ভালো জিনিস। অবৈধ বলতে কোথায়, আমি বুঝলাম না। রাজউক যে বলছে অবৈধ, আমি দেখিনি।’
মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না বলে দাবি মেয়র আতিকুলের। তিনি বলেন, পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তা না করলে এটা-ওটা চুরি হবে। এর জন্যই প্রক্রিয়া অনুযায়ী ইয়ুথ ক্লাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা সেখানে খেলতে যাবে, তারা খেলবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ দখলকারী কারও কাছ পার্কের দায়িত্ব দেওয়া হলে বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। প্রতিকার করা উচিত। তা ছাড়া জনগণের জন্য করা পার্কে জনগণের অবাধ ব্যবহারের অধিকার থাকতে হবে। জনগণের পার্কের বাণিজ্যিক ব্যবহার একটি গর্হিত অপরাধ।