শুধু আইন করে বা আইন পরিবর্তন করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না করলে সংগ্রামের ফসল ঘরে তোলা যাবে না।
আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বিদ্যমান ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’–এর সঠিক ব্যাখ্যা জানা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করে ‘হেফাজতে নির্যাতন ও দায়বদ্ধতা: প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকার’ শিরোনামে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভার একজন প্যানেল আলোচক ছিলেন জোরপূর্বক গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, পুলিশি নির্যাতনে কোনো পরিবার স্বজন হারালে তাঁরা লড়াই অব্যাহত রাখতে পারেন না। এ জন্য আর্থিক ও সামাজিক শক্তি থাকে না। এ ক্ষেত্রে আইনের পরিবর্তন করেও কোনো লাভ নেই। যদি পরিবেশের উন্নতি করা না যায়, দেশে গণতন্ত্রের আভা তৈরি করা না যায়, তবে আইন কোনো কাজে আসবে না।
দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতির (ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন) কথা উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘আজকে মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, আমরা একটা মুক্ত অবস্থায় আছি। অথচ মানুষ যেভাবে মুক্ত চিন্তা করে, সেই জায়গাটিতে আমরা যেতে পারিনি। ওই জায়গায় যতক্ষণ পর্যন্ত যেতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন বা অনেক ভালো আইনকেও কাজে লাগাতে পারব না।...দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি পরিবর্তন করা না যায়, গণতন্ত্রকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দেওয়া যায় তাহলে প্রতিদিন আমরা সংগ্রামে জিতব। কিন্তু পরদিন সেই সংগ্রামের ফসল ঘরে তুলতে পারব না।’
সভায় সমাপনী বক্তব্যে ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না তিনটি আইন পরিবর্তনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা যাঁর হাতে, তিনি সিভিলিয়ান হোক, ডিফেন্সের হোক বা ক্ষমতাসীন দলের হোক, তাঁর কথা অন্যায় হলেও আমরা মেনে চলি। মেনে চলার যে প্রবণতা, এটা আমাদের বাদ দিতে হবে। না বলা শিখতে হবে। প্রতিনিয়ত প্রতি পদে পদে প্রতিবাদ করতে হবে। পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে। পোশাক পরিবর্তন করা হলে মানসিকতা পরিবর্তন হবে, এটা তো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। পুলিশের আইনটা (পিআরবি) পরিবর্তন করা উচিত। পাশাপাশি দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি পরিবর্তন করা উচিত।’
দেশে বিদ্যমান সংবিধানের খুব বেশি সংশোধনের প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘অনেকেই বলেন, সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আমি এখানে একমত না। আমাদের সংবিধান যেটা আছে, দু–একটা জায়গায় সংশোধন করা প্রয়োজন। এটা বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান। বিষয় হলো অন্যায় কাজ করার জন্য কিন্তু কেউ লিখিত আদেশ দেন না। এটা মৌখিকভাবেই দেওয়া হয়।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘জুলাই মাসে যেটা ঘটেছে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর এটা দ্বিতীয় বৃহত্তম হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া দরকার। রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, এই হত্যার জন্য তাঁরা দায়ী। পারিপার্শ্বিক প্রমাণও সেটা বলে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাদের মতামত ছাড়া অত বড় হত্যাকাণ্ড হতে পারে না।’
ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন তাঁর বক্তব্যে হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের আইনগত সুরক্ষার পাশাপাশি আর্থিক ও সার্বিক সহায়তার ওপর জোর দেন। পাশাপাশি জুলাই থেকে ৫ আগস্ট নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের যথাযথ সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।
হেফাজতে নির্যাতন–মৃত্যু বন্ধে এবং এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধানে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু স্টেট বা ব্যক্তিবিশেষের কথা বলা নেই। বলা আছে, যেকোনো ধরনের নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ একেবারে নিষিদ্ধ। একটি গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হওয়া, ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্নমতের বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণ করা যাবে না। যখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করব, এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের বিরুদ্ধেও কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল নোমান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’–এর অধীনে প্রথম রায় পাওয়া ইশতিয়াক হোসেন জনি হত্যা মামলাবিষয়ক সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা করেন ব্লাস্টের স্টাফ আইনজীবী নাজমুল করিম।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক, ব্লাস্টের প্যানেল আইনজীবী মো. আবু তৈয়ব এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হেফাজতে নির্যাতনে ভুক্তভোগী ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফামিয়া সাগর।
পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, সেটাও লিখতে পারছিলেন না চিকিৎসক
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুসনদে আঘাতের ধরন বদলে দিতে হয়েছে বলে সভায় উল্লেখ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মোশতাক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক একটি ঘটনা আমি শেয়ার করতে চাই। আজিমপুরে একজন ভদ্রলোক মারা গেছেন গানশট ইনজুরিতে (গুলিতে)। সেটা বলা হইছিল আমাদের, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, এটা ডেথ সার্টিফিকেটে (মৃত্যুসনদ) লেখা যাবে না। লিখতে হবে তিনি এক্সিডেন্টালি (দুর্ঘটনায় মৃত্যু) মারা গেছেন।’ এমন নির্দেশনা কে দিয়েছিল, জানতে চাইলে মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘এটা হসপিটাল অথরিটি (কর্তৃপক্ষ)।’